চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। এদিন ভোরের আকাশে ছিল কালো মেঘের ঘনঘটা। সূর্যের হাসিও ছিল ম্লান। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রাজপথ ছিল থমথমে। যানবাহন, জনমানবশূন্য এক নীরব-নিস্তব্ধ সকাল। চারদিকে ফিসফাস, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের বার্তা শোনার অপেক্ষায় জনতা। কিন্তু তখনো ছিল নানা সংশয়, গুঞ্জন। আদৌ কি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন! না কি পর্দার আড়ালে ভিন্ন কিছু ঘটতে যাচ্ছে!
তবে বেলা গড়াতেই সংশয়ের কালো মেঘ কেটে যায়। ঘর ছেড়ে মানুষ আস্তে আস্তে রাস্তায় বের হতে শুরু করে। সড়কের মোড়ে মোড়ে জটলা, আদ্বেগ-আতঙ্ক নিয়ে নানা আলাপচারিতা। দুপুরে যখন টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন’, তখনই মুহূর্তের মধ্যে, সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশে মুক্তির প্রতীক্ষায় উন্মুখ চট্টগ্রামের লাখো জনতা নেমে আসে রাস্তায়। মিছিলে-মিছিলে সয়লাব হয়ে যায় পুরো বন্দরনগরী। গোধূলি বেলায় টকটকে লাল সূর্য প্রকৃতিতে মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে সেদিনের মতো বিদায় নেয়।
আগেরদিন ৪ আগস্ট সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও শিক্ষার্থী থেকে দিনমজুর, পেশাজীবী থেকে সমাজকর্মী- সবাই রাজপথে নেমে আসেন একযোগে। পুরো নগরীই চলে যায় কার্যত ছাত্র-জনতার দখলে। কিন্তু চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এদিন ছাত্র-জনতার ওপর দলীয় সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিহত হয় শতাধিক। চারদিকে আগুন, লাশ, কান্না আর ক্ষোভ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৬ আগস্ট কেন্দ্রীয়ভাবে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র আক্রমণের প্রেক্ষাপটে সংগঠনটি সেই কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনে। মূলত এই এক সিদ্ধান্তেই কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনঘণ্টা বেজে ওঠে। অর্থাৎ, ৪ আগস্টই মূলত শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এর পর ৫ আগস্ট দুপুরে হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে মূলত এর বাস্তবায়ন হয়।
৫ আগস্ট হাসিনার পালানোর খবর পাওয়ার মুহূর্তেই চট্টগ্রাম নগরীতে নেমে আসে জনতা। ‘নারায়ে তকবির, এইমাত্র খবর এল- শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল, পলাইছে রে পলাইছে-শেখ হাসিনা পলাইছে’– এমন নানা স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে রাজপথ। নগরীর অলিগলি থেকে রাজপথ, শুধু মিছিল আর মিছিল। মুক্তিপাগল জনতা কেউ মিষ্টি বিতরণ শুরু করে, কেউ একে অপরের সঙ্গে করমর্দন-আলিঙ্গন করে উদযাপন করতে থাকে স্বৈরশাসকের পতন।

নগরীর অলিগলি থেকে রাজপথ, শুধু মিছিল আর মিছিল। ছবি: সারাবাংলা
দীর্ঘদিন পর বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে মুক্তির স্বাদ নিয়ে মিছিল করতে থাকেন। মাদরাসা থেকে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় লাখো সাধারণ জনতা। নগরীর কাজির দেউড়ি, আসকারদিঘী, জামালখান, আন্দরকিল্লা, লালদিঘী থেকে নিউমার্কেট, আবার চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর, জিইসি মোড়, ওয়াসা, টাইগারপাস হয়ে আগ্রাবাদ, বন্দর, সল্টগোলা, ইপিজেড, কাটগড়, পতেঙ্গা- সবখানেই শুধু মানুষ আর মানুষ।
কার্যত চট্টগ্রাম নগরী জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিভিন্নস্থানে সেনাসদস্যদের জড়িয়ে ধরে জনতাকে উল্লাস করতে দেখা যায়। মোটরসাইকেল, রিকশা, ইজিবাইক, ট্রাকে চড়ে মানুষ রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। কারও হাতে জাতীয় পতাকা, কেউ-বা লাঠির মাথায় লাল কাপড় বেঁধে শূন্যে উঁচিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। এভাবে বিজয় উল্লাস, মিছিল, বিজয় সমাবেশ চলে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত পর্যন্ত।
এদিকে বিকেল থেকেই বিক্ষুব্ধ জনতা চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন থানা, পুলিশের স্থাপনা এবং আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতাদের বাড়িতে হামলা শুরু করে। জনতার রোষের মুখে থানাগুলো থেকে পালিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। এদিন চট্টগ্রাম নগরীর ১১টি থানা আক্রান্ত হয়। আগুন দেওয়া হয় আটটি থানায়। ছয়টি থানা থেকে লুট করে নেওয়া হয় অস্ত্র। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, ইপিজেড, সদরঘাট ও ডবলমুরিং থানা।

নগরীর অলিগলি থেকে রাজপথ, শুধু মিছিল আর মিছিল। ছবি: সারাবাংলা
নগরীর লালদিঘীর পাড়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নিউমার্কেট এলাকায় দোস্ত বিল্ডিংয়ে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দারুল ফজল মার্কেটে নগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। নগরীর বহদ্দারহাটে সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। নগরীর পাথরঘাটায় সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিমের বাসায় আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।
এ ছাড়া নগরীজুড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় সব ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়। শেখ হাসিনার ছবি ও নামফলক ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। তবে হামলা থেকে রক্ষায় নগরী ও জেলায় বিভিন্ন মঠমন্দিরে পাহারা বসায় বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা।
নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান চট্টগ্রামের বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জনরোষ থেকে বাঁচতে পালাতে থাকেন। অবশ্য আগেরদিন থেকেই আওয়ামী লীগের পরিচিত মুখগুলো গা ঢাকা দেয়।
এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের দিনটি পার করে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে উদিত হয় নতুন সূর্য।