রংপুর: আজ ৫ আগস্ট ২০২৫। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একবছর পূর্তি। ঠিক একবছর ১৪ দিন আগে, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একটি তরুণ দাঁড়িয়েছিলেন বন্দুকের নলের মুখে, দুই হাত প্রসারিত করে, বুক টানটান। ন্যায্যতার অধিকার চেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন একজন। তিনি হলেন আবু সাঈদ। ২৫ বছরের এক তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক।
দিনটি ছিল ১৬ জুলাই ২০২৪। পুলিশের ছররা গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ। তার এই আত্মদান জ্বালিয়ে দেয় একটি জাতির দ্রোহের আগুন। পুলিশের গুলিতে তার লুটিয়ে পড়ার ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সঙ্গে সঙ্গে আবু সাঈদ হয়ে ওঠেন গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক। একবছর পর, তার স্মৃতি এখনো ১৭ কোটি হৃদয়ে ধিকিধিকি জ্বলে। তার পরিবারের কান্নায় মিশে আছে একটি জাতির কৃতজ্ঞতা।
দারিদ্র্যের মধ্যেও বড় স্বপ্ন
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে ২০০১ সালে জন্ম নেওয়া আবু সাঈদ ছিলেন মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগমের নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। দারিদ্র্যের মধ্যেও তার চোখে ছিল বড় স্বপ্ন। জাফর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পান। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে। পড়াশোনায় বেশ মনযোগী ছিলেন। টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন তিনি, পরিবারের দুঃখ-কষ্ট দূর করার স্বপ্ন দেখতেন।
তার বাবা মকবুল হোসেন শারীরিকভাবে অসুস্থ, মা মনোয়ারা বেগমের চোখে ছিল ছোট ছেলের জন্য অফুরন্ত আশা। তার বড় ভাই রমজান আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে তাকে পড়িয়েছি। সে ছিল আমাদের পরিবারের গর্ব।’ কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ১৬ জুলাইয়ের সেই কালো দুপুরে।
একটি প্রাণের আত্মদান
২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশজুড়ে তীব্র হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পর ২০২৪ সালে হাইকোর্টের রায়ে তা পুনর্বহাল হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আবু সাঈদ ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুরের সমন্বয়ক। তিনি বিশ্বাস করতেন, ন্যায্য কোটা ব্যবস্থা ছাড়া মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
১৬ জুলাই, রংপুরের পার্ক মোড়ে বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশ টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট আর ছররা গুলি ছুড়ছিল। ইংরেজি বিভাগের অধ্যায়নরত আবু সাঈদের বড় ভাই শিপন তালুকদার ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদুজ্জামানের বর্ণনায়, সবাই পিছু হটলেও সাঈদ দাঁড়িয়ে রইলেন। হাতে একটি সাধারণ লাঠি, দুই হাত প্রসারিত, তিনি যেন বলতে চাইলেন, ‘আমি ভয় পাই না।’ মাত্র কয়েকমিটার দূর থেকে একের পর এক পুলিশ সদস্য তার ওপর শটগানের ছররা গুলি ছোড়েন। তার মুখ থেকে ঊরু পর্যন্ত ছররা গুলি লাগলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তারা বলেন, ‘সেই দৃশ্য মনে হলে আমরা নির্বাক হয়ে যাই। ক্লাসে তার শূন্য আসন আমাদের বুক চিরে দেয়।’ সেদিনের সাঈদের মৃত্যুর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। সেই ছবি— দুই হাত প্রসারিত, বুক উঁচিয়ে গুলির মুখে দাঁড়ানো— হয়ে ওঠে আন্দোলনের ‘আইকন’। দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার, এমনকি রাষ্ট্রীয় নথিতেও ব্যবহৃত হয় এই ছবি।
পরিবারের শূন্যতা: একটি মায়ের কান্না
আবু সাঈদের বাড়ি রংপুর শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে। বাঁশের বেড়ায় ঘেরা তার কবর এখন মানুষের জিয়ারতের স্থান। মাটির ঘরের জায়গায় সরকারের দেওয়া টিনের আধা-পাকা বাড়ি হলেও, মা মনোয়ারা বেগমের কান্না থামে না। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা নাই। টাকা-পয়সা সব আছে, কিন্তু আমার বাবা নাই। ঘুম আসে না, সব উলটা-পালটা লাগে।’
বাবা মকবুল হোসেনের বুক ভেঙে যায় সেই দিনের কথা মনে করে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাশও কেড়ে নিয়েছিল পুলিশ। রাত ৩টায় লাশ ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু দেখতে দিতে চায়নি। আমি বলেছি, আমার ছেলেকে আমার মতো করে মাটি দিতে হবে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ‘এক বছর হলো, মাত্র চারজন আসামি ধরা পড়েছে। বাকিদের বিচার কই?’
বড় ভাই রমজান আলী, যিনি হত্যা মামলার বাদী তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ভাই নম্র-ভদ্র ছিল। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। তার স্মৃতি মনে পড়লে আমি আর থাকতে পারি না।’ তারা সবাই বিচারের অপেক্ষায়, কিন্তু বিচারের গতি তাদের হতাশ করছে।
গণঅভ্যুত্থান: একটি জাতির জাগরণ
আবু সাঈদের মৃত্যু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেয়। তার ছবি ছড়িয়ে পড়ে, ক্ষোভের দাবানল জ্বলে ওঠে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী— সারাদেশে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। শেখ হাসিনার বিভিন্ন মন্তব্য, হাসিনা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ক্ষোভকে আরও উসকে দেয়। ১৬ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘর্ষে শত শত নিহত হন, হাজার হাজার আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার এত এত পদক্ষেপ নিলেও ছাত্র-জনতাকে দমাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপদেষ্টা, রাজনীতিক এই অভ্যুত্থানে আবু সাঈদের আত্মদান এই আন্দোলনের ‘স্ফূলিঙ্গ’ হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ টানেন শতবার।
বিচারের অপেক্ষায় একটি জাতি
১৮ আগস্ট ২০২৪-এ শহিদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী ১৭ জনের নামে এবং ৩০-৩৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ছাড়া, ৩০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়। বর্তমানে চার আসামি কারাগারে— পুলিশের সাবেক এসআই আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম এবং ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী আকাশ। বাকি ২৪ জন পলাতক, তাদের গ্রেফতারে ট্রাইব্যুনাল সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে ছররা গুলিতে। রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’ তবু আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে দাবি করা হয়েছিল, তিনি মাথায় আঘাতে মারা গেছেন। এই ধোঁয়াশা পরিবারের বুকে আরও ক্ষত তৈরি করেছে।
তার ত্যাগের যেন আমরা মূল্য দিতে পারি
আবু সাঈদের শিক্ষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ আল মতিন সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আবু সাঈদ নম্র, ভদ্র ছিল। তার জীবন অন্যরকম হতে পারত। তার ত্যাগ যেন আমরা মূল্য দিতে পারি। তার সহপাঠীরা ক্লাসে তার শূন্যতা অনুভব করেন। তার ছবি এখন শুধু একটি ছবি নয়— এটি একটি জাতির স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সংগ্রামের প্রতীক। তার নামে কবিতা লেখা হয়েছে, ফন্ট তৈরি হয়েছে, তার স্মৃতি জ্বলছে প্রজন্মের হৃদয়ে।’
তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদ চলে গেছেন, কিন্তু তার আত্মা বেঁচে আছে। তার পরিবারের কান্না আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ন্যায়ের পথ কঠিন, কিন্তু একটি প্রাণের আত্মদানও পারে একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে।’
তার বাবা মকবুল হোসেনের বলেন, ‘আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করে। আর আমরা যেন তার ঋণ শোধ করতে পারি তার স্বপ্নের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।’
আবু সাঈদের সঙ্গে শুরু থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাবেক সমন্বয়ক শাহরিয়ার সোহাগ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন পুলিশের উপর্যুপরি ছোড়া ছররা গুলিতে আবু সাঈদ, আমিসহ আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হই। তবে আমি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। আল্লাহর রহমতে পরে সুস্থ হয়েছি।’
তবে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর শহিদ আবু সাঈদের লিগ্যাসি নষ্ট করেছে কিছু মানুষ তাদের নিজ স্বার্থ স্ট্যাবলিশড করার জন্য।’ তিনি মনে করেন ৩৬ জুলাইয়ের আন্দোলন মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। কোটা সংস্কার আন্দোলন ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত; এখানে প্রথম ধাপের আন্দোলনের সূত্রপাত ও নেতৃত্ব ছিল ঢাকা। মূলত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। আর রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট; রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ রংপুর থেকে জ্বলে ওঠে, এবং পরে আবু সাঈদের সেই দু্র্দমনীয় সাহস বুকে ধারণ করে সবাই রাস্তায় নেমে এলেই তা ক্রমে দাবানলে পরিণত হয়।
তিনি জাতিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘১৬ জুলাই না ঘটলে বাংলাদেশে এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের কি পরিণতি হতো? হতে পারতো অনেককিছুই।’
দেশের আপামর জনতা রংপুরের শহিদ আবু সাঈদের দু’হাত প্রসারিত করা যেই দৃশ্য, যে সাহসে উদ্দীপ্ত হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল, তারা এখনো সেই আবু সাঈদকে চব্বিশের ইমাম এবং রংপুরের সেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবলা মানে বলে মনে করেন তিনি।