Monday 11 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একবছর
রংপুরের ৬ মামলার তদন্তে শ্লথগতি, বিচারের অপেক্ষায় শহিদ পরিবারগুলো


৬ আগস্ট ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ৬ আগস্ট ২০২৫ ১৪:২০

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একবছর। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

রংপুর: ৫ আগস্ট ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথমবার্ষিকী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়, যে আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবি থেকে শুরু হয়ে দেশের রাজনৈতিক ভূ-প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছিল। তবে রংপুরের মাটিতে এই দিনটি শুধু বিজয়ের উৎসব নয়, বরং হারানো সন্তানের জন্য মায়ের কান্না, স্ত্রীর নিঃশব্দ ক্ষোভ, আর ন্যায়ের অপেক্ষায় থমথমে এক অধ্যায়ের স্মৃতি।

গতবছর ১৯ জুলাই রংপুর মহানগরীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ছয়জন। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রংপুরের রাস্তা। কিন্তু একবছর পরেও তাদের পরিবারের ন্যায়ের আকুতি অপূর্ণ, তদন্তের গতি শ্লথ, আর মামলাগুলো ঘিরে অভিযোগ উঠেছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের।

বিজ্ঞাপন

ছয়টি প্রাণের অপেক্ষা…

মেরাজুল একজন কলা ব্যবসায়ী, যার প্রতিদিনের রোজগারে সংসার চালতো। আব্দুল্লাহ আল তাহির একজন শিক্ষার্থী, যার স্বপ্ন ছিল দেশের জন্য কিছু করা। সাজ্জাদ একজন ব্যবসায়ী, যিনি পরিবারের হাসি ছিলেন। মোসলেম উদ্দিন সোনার দোকানের কর্মচারী, যার পরিশ্রমে চলতো পরিবার। মানিক একজন অটোচালক, যিনি রাস্তায় জীবিকার তাগিদে ছুটতেন। আর যুবক মাহমুদুল হাসান মুন্না, যার জীবন সবে শুরু হয়েছিল। এই ছয়জনের জীবন থেমে গিয়েছিল গত বছরের ১৯ জুলাই। রংপুর জিলা স্কুল থেকে ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল সিটি বাজারের কাছে পৌঁছেছিল। তখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডারদের হামলা আর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে তাদের জীবন শেষ হয়ে যায়। অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন, যাদের অনেকেই এখনো শারীরিক ও মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

মেরাজুলের মা আম্বিয়া বেগমের চোখে এখনো শুকায়নি অশ্রু। সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে কলা বেচে আমাদের মুখে হাসি ফোটাতো। কিন্তু সেদিন সে আর ফিরল না। আমাকে কয়েকজন আইনজীবী এসে বললেন, মামলা করতে। কিন্তু আমি তো জানিও না কাদের নামে মামলা করা হয়েছে। আমি শুধু আমার ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তি চাই।’ তার কণ্ঠে শুধু বেদনা নয়, এক অজানা শূন্যতা।

একইভাবে সাজ্জাদের স্ত্রী জিতু বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বামীকে হারিয়ে আমার জীবন থমকে গেছে। মামলায় ৫৭ জনের নাম আছে, আরও শত শত অজ্ঞাত আসামি। কিন্তু আমি কাউকে চিনি না। আদালতে এফিডেফিট দিয়েছি। কারণ, অনেকে সেদিন ছিলই না। আমার স্বামীর হত্যাকারী কারা, তা কেন জানা যাচ্ছে না?’ তার প্রশ্নে যেন পুরো রংপুরের হতাশা প্রতিধ্বনিত হয়।

মামলার তদন্তে শ্লথ গতি, বাণিজ্যের অভিযোগ

ছয়টি হত্যা মামলায় মোট ২ হাজার ৬৩৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, নীলফামারীর ডিমলার এমপি আফতাব আহমেদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ১২৫ জন, যারা বর্তমানে কারাগারে আছেন। কিন্তু যারা গুলি চালিয়েছিল, যারা নির্দেশ দিয়েছিল— পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ সেইসব কর্মকর্তা— তাদের কেউই গ্রেফতার হয়নি। রংপুর সিআইডির প্রধান পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে, কিন্তু কবে শেষ হবে তা বলতে পারছি না।’ এই অনিশ্চয়তা নিহতদের পরিবারের ক্ষত আরও গভীর করছে।

মামলাগুলোর তদন্তে আরও জটিলতা যোগ করেছে বাদীদের এফিডেফিট। ছয়টি মামলার বাদীরা বলছেন, তারা আসামিদের চেনেন না, এমনকি অনেকের নাম তারা মামলায় দেননি। জিতু বেগমের এফিডেফিটে উল্লেখ করা হয়েছে, সাবেক মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার উত্তম কুমারসহ ১৫ জনের নাম ফেসবুক পোস্ট দেখে মামলায় যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু তারা ঘটনাস্থলে ছিলেন না। একইভাবে, মানিকের মা নুর জাহান বেগম ৫০-৬০ জন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তার নাম প্রত্যাহার করে এফিডেফিট জমা দিয়েছেন।

রংপুরের সিনিয়র আইনজীবী রইছ উদ্দিন বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এফিডেফিটে বলা হচ্ছে- চিনি না, আসামি করিনি’— এতে মামলার আইনি মূল্য কমে যায়। এর পেছনে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। অনেক নিরীহ মানুষ ফাঁসানো হয়েছে।’

এই অভিযোগ আরও জোরালো করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির সাবেক মুখ্য সমন্বয়ক নাহিদ হাসান খন্দকার। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘৮০ শতাংশ আসামি নিরপরাধ। মূল হত্যাকারী তারা পুলিশের যারা গুলি চালিয়েছে, যারা নির্দেশ দিয়েছে। তারা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। পুলিশে এখনো ফ্যাসিস্টদের দোসর আছে।’

একটি আন্দোলনের উত্থান

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয়েছিল। ১ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ, গণপদযাত্রার মাধ্যমে তাদের দাবি তুলে ধরে। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ন, পুলিশি হামলা, আর ছাত্রলীগের সহিংসতায় আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। রংপুরে ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু পুরো দেশকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে। ১৬ জুলাইয়ের ঘটনা ছিল এই আন্দোলনের একটি টার্নিং পয়েন্ট, যখন ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা পিছু হটে, আর পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়।

এই আন্দোলন শুধু রংপুরে সীমাবদ্ধ ছিল না। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, এবং ৫ আগস্ট ২০২৪-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে এর পরিণতি ঘটে। এই দিনটি এখন ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষিত হয়েছে। তবে রংপুরের ছয় পরিবারের জন্য এই দিনটি শুধুই ক্ষতের স্মৃতি।

ন্যায়ের আকুতি

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রংপুরে আহতদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু নিহতদের পরিবারের জন্য এই স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়। তারা চায় প্রকৃত হত্যাকারীদের শাস্তি। নাহিদ হাসান খন্দকার বলেন, ‘আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি। কিন্তু যারা আমাদের ভাইদের মেরেছে, তারা এখনো মুক্ত। এটা কি ন্যায়?’

তদন্তের বিষয়ে যা বলছে পুলিশ

ছয়টি হত্যা মামলার মধ্যে চারটির তদন্ত করছে সিআইডি। এ ব্যাপারে রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী বলেন, ‘তদন্ত চলছে, কতদিন শেষ হতে লাগবে তা জানাতে পারছি না।’ তবে প্রকৃত হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার প্রত্যয় পুলিশের এই কর্মকর্তার।

সারাবাংলা/পিটিএম

৬টি হত্যা মামলা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর শ্লথগতি