Wednesday 01 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্বাচনি আসন পুনর্বিন্যাস
ভোটার বিবেচনা নয়, বড় শহরের জন্য আলাদা পদ্ধতি দরকার

নাজনীন লাকী নাজনীন লাকী স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৬ আগস্ট ২০২৫ ২৩:৪১ | আপডেট: ৭ আগস্ট ২০২৫ ১২:২৭

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। ফাইল ছবি

ঢাকা: জনসংখ্যা ও ভোটার বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৩০০ নির্বাচনি আসনের ৩৯টিতে পরিবর্তন এনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে আসনের সীমানা নির্ধারণের এই প্রক্রিয়াকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনকে ঢাকার মতো বড় বড় শহরগুলোর জন্য আসন পুনর্বিন্যাসে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

গত ৩০ জুলাই সীমানা পুনর্নির্ধারণে খসড়া তালিকার গেজেট প্রকাশ করে ইসি। জানা গেছে, প্রতিটি আসনের গড় ভোটার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৫০০। এটা ধরে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় সংসদীয় আসন পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে খসড়া তালিকায় গাজীপুরে একটি আসন বেড়ে ছয়টি করা হয়েছে। আর বাগেরহাটের চারটি আসন থেকে একটি কমিয়ে তিনটি করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যেসব আসনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে

পঞ্চগড়-১ ও ২; রংপুর-৩; সিরাজগঞ্জ-১ ও ২; বাগেরহাট-২ ও ৩; সাতক্ষীরা-৩ ও ৪; শরীয়তপুর-২ ও ৩; ঢাকা-২, ৩, ৭, ১০, ১৪ ও ১৯; গাজীপুর- ১, ২, ৩, ৫ ও ৬; নারায়ণগঞ্জ-৩, ৪ ও ৫; সিলেট-১ ও ৩; ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩; কুমিল্লা-১, ২, ৯, ১০, ১১; নোয়াখালী-১, ২, ৪ ও ৫; এবং চট্টগ্রাম-৭ ও ৮।

যে কারণে বাকি আসনগুলোর সীমানা অপরিবর্তিত

পার্বত্য এলাকার তিন জেলার তিনটি আসন অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া, দুই আসনবিশিষ্ট জেলার আসন সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। কারণ, ভোটার/জনসংখ্যার অনুপাতে আসন বাড়ালে জেলাভিত্তিক ভোটারের জাতীয় গড়ের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। আবার দু’টি আসনকে একটি করলে ভোটার সংখ্যা গড়ের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। এর বাইরে তিন আসনবিশিষ্ট জেলার আসন সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আর যেসব আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য কোনো আবেদন দাখিল হয়নি, সেই আসনগুলো অপরিবর্তিত রয়েছে।

সীমানা পুনর্নির্ধারণে যেসব পদ্ধতি প্রাধান্য পেয়েছে

প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে উপজেলা/থানা ইউনিটকে যতদূর সম্ভব অখণ্ড রাখা হয়েছে। জেলার মধ্যকার আসনের ভোটার সংখ্যা সবোর্চ্চ ৩০ শতাংশ ব্যবধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। যতদূর সম্ভব প্রশাসনিক ও নির্বাচনি সুব্যবস্থার বিষয় বিবেচনায় রেখে উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডের অখণ্ডতা বজায় রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন, সিটি কপোরেশনের ওয়ার্ড ও পৌরসভার একাধিক সংসদীয় আসনের মধ্যে বিভাজন না করার চেষ্টা হয়েছে। সিটি করপোরেশন এলাকার জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা, প্রশাসনিক পরিধি বিবেচনায় নির্বাচনি এলাকা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।

সীমানা পুনর্নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের সেবাবিষয়ক সুবিধা/অসুবিধার বিষয় যতদূর সম্ভব বিবেচনা করা হয়েছে। ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য (যেমন নদীর অবস্থান) ও যোগাযোগ ব্যবস্থার (যেমন রাস্তাঘাট) মত সুবিধা ও অসুবিধা যতদূর সম্ভব বিবেচনায় আনা হয়েছে। যেসব প্রশাসনিক এলাকা নতুন সৃষ্টি হয়েছে বা সম্প্রসারণ হয়েছে বা বিলুপ্ত হয়েছে তা অন্তর্ভুক্ত/কর্তন করা এবং পরিবর্তিত নাম সংশোধন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৩৯টি আসনে পরিবর্তন এনে, দ্বাদশ সংসদের ২৬১টি আসনের সীমানা বহাল রাখা হয়েছে। আগামী ১০ আগস্ট পর্যন্ত অভিযোগ, দাবি ও আপত্তি জানানো যাবে। এরই মধ্যে দাবি ও আপত্তি জানিয়ে আবেদন করছেন অনেকেই। এসব দাবি-আপত্তি শুনানির পর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারাদেশের জন্য যে পদ্ধতিতে আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে তা সাধারণভাবে দেখলে যুক্তিযুক্ত। যৌত্তিকভাবেই কমিশন ৩০০ আসন পুনর্বিন্যাস করেছে। কারণ, কমিশনের উদ্দেশ্য গ্রাম ও শহরের মাঝে যে বৈষম্য সেটা কমিয়ে আনা। সেজন্য এই উদ্যোগটা ভালো।’

জনসংখ্যা ও ভোটার বিবেচনায় আসন বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে কি ঢাকার আসন ২০ থেকে বেড়ে ৪০টি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কমিশনের এই পদ্ধতি ঢাকার জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, আগে ঢাকার আসন ছিল আটটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০টি। কারণ, ঢাকা শহরে প্রতিদিনই জনসংখ্যা বাড়ছে। আর এতে বাড়ছে ভোটার সংখ্যাও। কিন্তু ভোটার বাড়লে আসনের আয়তন তো বাড়ছে না। তাই জনসংখ্যা আর ভোটারের ভিত্তিতে যদি আসন বাড়ে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে, শুধু ঢাকার আসনই অনেক বেড়ে যাচ্ছে। তাই, বাকি সব আসনের মতো স্বাভাবিক নিয়মে ঢাকার আসন পুনর্বিন্যাস করা ঠিক হবে না।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকার মতো বড় বড় শহরের জন্য আলাদা কমিটি করে আলাদা পদ্ধতি বের করতে হবে। নির্বাচনি আসন পুনর্বিন্যাসসহ নানা আয়োজন তো জনগণের একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার জন্যই। আর এই জনপ্রতিনিধি বা সংসদ সদস্য জনগণের জন্য আইন প্রণয়নের কাজটাই তো করে থাকেন। এটি তার একমাত্র সংবিধান উল্লিক্ষিত কাজ। বাকি সামাজিক, মানবিক ও প্রাশাসনিক কাজ একজন সংসদ সদস্য করে থাকেন সরকারের ইচ্ছেতেই।’

ঢাকার মতো শহরে যেখানে একেক এলাকাতেই ৪/৫ লাখ লোক বাস করে, সেখানে জনসংখ্যা আর ভোটার সংখ্যা হিসাবে যদি এলাকাভিত্তিক একজন এমপি নির্বাচিত হন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকার আসন সমিতির মতো হয়ে যাবে বলে মনে করছেন কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তাই সম্মিলিতভাবে বড় বড় শহরের জন্য আলাদা পদ্ধতি বের করার পরামর্শ তার।

আরেক নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই আমাদের আসন ৩০০। কিন্তু সেসময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ৭ কোটি। কিন্তু আমাদের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। আমাদের আসন না বাড়লেও বেড়েছে জনসংখ্যা। সেজন্য সংস্কার কমিশন থেকে আমরা জনসংখ্যা ও ভোটার সমন্বয়ের কথা বলেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, একদিকে একজন ৭০ লাখ মানুষের এমপি। আবার আরেকদিকে একজন এমপি মাত্র ৫ বা ১০ লাখ মানুষের। এজন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য আলাদা গড় পপুলেশন হিসাবে ধরে কোটাভিত্তিক আসন ভাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে সিটি করপোরেশন এলাকায় ওয়ার্ডগুলোকে আলাদা না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। সেইসঙ্গে উপজেলাগুলোকেও আলাদা না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।’

ইসির খসড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইসি যে খসড়া তালিকা দিয়েছে এতে আমাদের দেওয়া পরামর্শগুলোকে আমলে নিয়েছে। তারা কমিটি গঠিন করে, সেই কমিটির দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছে। সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ।’

এদিকে, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ আসন পুনর্বিন্যাসে সারা দেশে সমতা আনার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকায় জনসংখ্যা বেশি হলেও আসন সংখ্যা বেশি হবে না। তখন বিবেচনায় আসবে আয়তন। আসন বিন্যাসে সামগ্রিক সমতাটা বড় প্রয়োজন। আসন পুনর্বিন্যাসে জনসংখ্যাই তো একমাত্র নির্ণায়ক নয়। ঢাকায় যদি আসন সংখ্যা বাড়েও তাহলে সেখানেও সমতা আনতে হবে কমিশনকে।’ ঢাকায় জনসংখ্যা আর ভোটার বেশি হলেই যেন আসন না বাড়ে সে বিষয়ে কমিশনকেই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।

সারাবাংলা/এনএল/পিটিএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর