ঢাকা: ৮ আগস্ট ২০২৪, বৃহস্পতিবার। দুপুর ২টা পেরিয়ে গেলে নতুন এক বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চোখে-মুখে প্রাজ্ঞতা, কণ্ঠে অভিজ্ঞতার ভার। বার্ধক্য নয়, বরং নবজাগরণের প্রত্যয় নিয়েই ফিরেলন তিনি। সারা বিশ্বের কাছে প্রাজ্ঞজন হিসেবে পরিচিত এই মানুষটিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে জড়ো হন সেই তরুণ প্রজন্ম, যারা সদ্যই রক্ত ও সাহস দিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে বদলে দিয়েছে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র। সেইসঙ্গে স্বাগত জানাতে যান সেনাবাহিনী প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরা।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের পর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার একদফা আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। বিলুপ্ত হয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতৃত্বের দাবিতে শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন প্রক্রিয়া। ৬ আগস্ট বৈঠক হয় বঙ্গভবনে। যেখানে সিদ্ধান্ত হয়— ড. ইউনূস হবেন এই রূপান্তরের অভিভাবক। এবার সময় সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।
পুনর্জন্মের বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়
ড. ইউনূস ফিরেই সাংবাদিকদের বললেন, ‘পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশ পেলাম, সে বাংলাদেশ যেন পূর্ণতা পায়। এই আন্দোলন শুধু সরকারের পতনের নয়, এটি একটি আন্তরিক মূল্যবোধের বিপ্লব, যেখানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে একটি প্রজন্ম।’ আবেগ ধরে রাখতে পারেননি ইউনূস। আবু সাঈদের নাম উচ্চারণ করতেই কেঁদে ফেলেন তিনি। সেই সাহসী তরুণ, যিনি রংপুরে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। তার কথাই যেন এখন জাতীয় চেতনার প্রতীক।
ড. ইউনূসের শপথ ও জনতার উল্লাস
এদিন বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে ভিআইপি গেট দিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন ড. ইউনূস। চারদিক থেকে ভেসে আসে— ‘ইউনূস স্যার এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে।’ রাত ৯টার পর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন তিনি। সেইসঙ্গে শপথ নেন আরও ১৬ উপদেষ্টা। এদের মধ্যে ছিলেন মানবাধিকারকর্মী, সাবেক আমলা, অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক, মাওলানা এবং তরুণদের প্রতিনিধি। তরুণদের মধ্য থেকে দুই ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া স্থান পান উপদেষ্টা পরিষদে।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় উপদেষ্টাদের
উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃত্বের প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে এই সরকার কাজ করবে। আমরা গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করব। সেইসঙ্গে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজটা করতে হবে।’
অপর ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, ‘আমরা একদফা ঘোষণার মাত্র চারদিনের মাথায় স্বৈরাচার পতন নিশ্চিত করেছি। এখন আমাদের দায়িত্ব নতুন একটি বাংলাদেশ উপহার দেওয়া।’ তাদের বক্তব্যে ছিল এক নতুন যুগের সূচনা, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে রাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত থাকবে জবাবদিহিতা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানাতে থাকে। সেইসঙ্গে তারা সতর্ক করে— মানবাধিকার, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা এবং শান্তিপূর্ণ উত্তরণ যেন অগ্রাধিকার পায়। বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো গভীর নজর রাখে রূপান্তরের দিকে।
পথে যত চ্যালেঞ্জ
এই সরকারকে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। সংস্কার করতে হবে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনিক কাঠামো, পুলিশি নির্যাতনের সংস্কৃতি— সর্বোপরি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ড. ইউনূস জানেন এই দায়িত্ব ইতিহাসের চেয়ে কম কিছু নয়। কিন্তু তার কণ্ঠে থাকে দৃঢ়তা— ‘আমার ওপর আস্থা রাখলে, কথা দিতে হবে।’
শেষ কথা
৩৬ দিনের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় শেখ হাসিনার ১৭ বছরের শাসনতন্ত্র। শুরু হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। সেই পথে রক্তের দাগ, সাহসের চিহ্ন এবং ত্যাগের গল্প আঁকা। অবশেষে ড. ইউনূস নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এই গল্পের প্রকৃত নায়ক বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। যারা দেখিয়েছে— পরিবর্তন কেবল ভোটে নয়, চেতনায়ও হয়।