পঞ্চগড়: খুব ছোটবেলা থেকেই নিজের বাবা-মায়ের স্নেহ বঞ্চিত আলামিন বেড়ে ওঠেছেন তাকে দত্তক নেওয়া বাবা-মায়ের কাছে। জীবন যুদ্ধে ছিলেন সংগ্রামী মানুষ, সেই সংগ্রামী চেতনা ছিল বাস্তবতায়ও। এজন্যই হয়তো সামান্য ইজিবাইক চালক হয়েও অংশ নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে। কোঠাবিরোধী আন্দোলন থেকে একদফা, পুরো আন্দোলনেই ছিলেন সরব। এরপর স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে যেন আত্মতুষ্টি পেয়েছিলেন ২৮ বছরের এই যুবক। কিন্তু সেদিনের পর কি ঘটেছিল আলামিনের ভাগ্যে? কোথায় আছেন তিনি- এই প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি সহযোদ্ধারা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই নিখোঁজ আলামিন। গত একবছরেও তার সন্ধান মেলেনি। বেঁচে আছেন কি-না তাও জানে না পরিবার। তবে অভিযোগ উঠেছে হত্যার পর আলামিনের লাশ গুম করেছে ঘাতকরা। এতে সরাসরি জড়িত জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান সাকিব পাটোয়ারী প্লাবন।
আলামিন বেড়ে ওঠেছেন পঞ্চগড় পৌর শহরের উত্তর দর্জিপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম মনু মিয়া। খুব ছোট বেলায় নিঃসন্তান মনু মিয়া তাকে দত্তক এনেছিলেন। তখন থেকেই তার পরিচয় মনু মিয়ার ছেলে। আলামিন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত, তার চার বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। সেই সন্তানকে আঁকড়ে এখনো স্বামীর অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তার স্ত্রী সুমি আক্তার।
জানা গেছে, আলামিনকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে- এমন অভিযোগে গতবছরের ১০ নভেম্বর সাবেক রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পঞ্চগড় সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন আলামিনের বাবা মনু মিয়া।
মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, আলামিন পেশায় ইজিবাইক চালক ছিলেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন- এজন্য আন্দোলনের শুরু থেকেই তাকে হুমকি দেওয়া হত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আলামিন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান সাকিব পাটোয়ারী প্লাবনের বাড়ির সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন কতিপয় আসামির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদদে অন্য আসামিরা তাদের কাছে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আলামিনকে জখম করে। এতে আলামিন লুটিয়ে পড়লে তারা তার দেহটি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। তখন থেকেই আলামিনের সন্ধান নেই।
এদিকে, আলামিন হত্যাকান্ডের শিকার এবং তার লাশ গুম করা হয়েছে- বলে মামলা চলমান থাকলেও জুলাই আন্দোলনের শহিদ তালিকায় তার নাম ওঠেনি। স্বীকৃতি পায়নি জুলাই যোদ্ধা হিসেবেও। ফলে সরকারি-বেসরকারি কোনো সুযোগ সুবিধাও পায়নি তার পরিবার। অন্যান্য শহিদ ও আহতদের পরিবারদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেয়া হলেও এখনো বঞ্চিত রয়েছে আলামিনের পরিবার।
আলামিনের শ্বশুরবাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের আমবাড়ি গ্রামে। বর্তমান তার স্ত্রী-সন্তান এখানেই থাকছেন। সম্প্রতি ওই বাড়িতে যায় প্রতিবেদক। কথা হয় তার স্ত্রী সুমি আক্তারের সঙ্গে। তার আহাজারি আর দীর্ঘশ্বাসে যেন ভারি হয়ে আছে চারপাশ। এ সময় সুমি আক্তারের কোলে ছিল ছোট্ট শিশু কন্যা আফরিন আক্তার। তবে এসবের কোনো কিছুই স্পর্শ করে না তাকে। চার বছরের অবুঝ এই শিশু চারপাশে যেন শুধু খুঁজে ফিরছে বাবার মুখ। অব্যক্ত বেদনায় ভরা চোখের ভাষায় সে যেন বলতে চাইছে, বাবা কোথায়? কখন ফিরবে বাবা?
উত্তর দর্জিপাড়া গ্রামে আলামিনের বাড়িতেও সুনসান নিরবতা। অসুস্থ মনু মিয়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল আলামিন। বাড়িভিটার সামান্য জমিটাও দিয়ে রেখেছেন ছেলের নামে। সেই ছেলে আজ এক বছর হলো নেই, ছেলে নাই বলে ছেলের বউও থাকে না তার বাড়িতে। প্রতিবন্ধী স্ত্রী রুনা আক্তারকে নিয়েই এখন তার সংসার। এ অবস্থায় ছেলের কথা মনে পড়লেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ঘরে যত্ন করে রাখা আলামিনের ছবি বের করে দেখেন। তবে তিনি মনে করেন, আলামিন এখনো বেঁচে আছে, তার কাছে ফিরে আসবে।

নিখোঁজ আলামিনের ছবি। ছবি: সারাবাংলা
আলামিনের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী ছাত্র জনতার আন্দোলন থেকে এক বছরেও ফিরেনি। বেঁচে আছে কি-না জানি না। মারা গেলে তার লাশটা পেলে অন্তত দাফন করে বলতে পারতাম এটা আমার স্বামীর কবর। সন্তান বড় হলে তাকেও তার বাবার কবর দেখাতে পারতাম।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘যারা শহিদ হয়েছেন তাদের পরিবারে যেমন শূণ্যতা, আমার পরিবারেও তেমন শূণ্যতা। কিন্তু সব শহিদের পরিবার যেভাবে সম্মানিত হলো, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলো- আমরা পাইনি। এখন সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছি। হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিত্যসঙ্গী। আমার সন্তানের ভবিষ্যত কি, কোন পরিচয়ে বেড়ে ওঠবে? যদি সত্যিই আমার স্বামী মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তাকে শহিদ স্বীকৃতি দেওয়া হোক। অন্তত আমার মেয়েটা জুলাই আন্দোলনে শহিদের সন্তান পরিচয়ে বড় হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকালীন পঞ্চগড়ের সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বলেন, ‘আলামিন আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। এক বছরেও প্রশাসন তার নিখোঁজের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি- এটা দুঃখজনক। যদিও আমরা বিভিন্নভাবে জেনেছি তাকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে। এজন্য আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছি তাকে জুলাই যোদ্ধার প্রাপ্য সম্মান নিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন- এটা অফিসিয়ালি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে তা সম্ভব হয়নি। তারপরও আমাদের দাবি- এক বছর ধরে পরিবারে তার অনুপস্থিতি যে সঙ্কট তৈরি করেছে, সেই সঙ্কট লাঘবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন উদ্যোগ নেন।’