ঢাকা: সরকার শুল্ক ছাড় কমানোর কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় শুল্ক ছাড় বেড়েছে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পেয়েছে আমদানি করা মেশিনারিজ, বিভিন্ন শিল্পের উপকরণ, ফ্রিজ ও এসি শিল্প, মোবাইল ফোনসেট উৎপাদক, পোলট্রি শিল্প ও বিভিন্ন খাতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্লেষকদের মতে, এই শুল্ক ছাড়ের প্রভাব সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ে পড়েনি। বরং শুল্ক ছাড় দেওয়া বিভিন্ন পণ্যের দাম বাজারে গ্রাহক পর্যায়ে বেড়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুসারে, বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুল্ক ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই শুল্ক ছাড়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ হাজার ১ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ১ কোটি টাকার বেশি শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলকভাবে শুল্ক অব্যাহতি বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। বিভিন্ন ধরণের কেপিট্যাল মেশিনারি, বিভিন্ন শিল্পের আমদানিকৃত উপকরণ, মোবাইল ম্যানুফেকচার, পোল্ট্রি ফার্ম, ফ্রিজ ও এসি ম্যানুফেকচার, অলিভওয়েল তেলসহ বিভিন্ন খাতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। গেল ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত এনবিআরের কাস্টমস অনুবিভাগের রাজস্ব পর্যালোচনা সভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
প্রসঙ্গত, শুল্ক ও কর অব্যাহতি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে। সরকারও কর অব্যাহতি কমাতে চায়। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের আগে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান ক্রমান্বয়ে ক্রয় অব্যাহতি কমানোর লক্ষ্যের কথা জানান। সরকার চাইলেই আর কর অব্যাহতি দিতে পারবেনা এমনটাও জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। তবে কর অব্যাহতি কমাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও গত অর্থবছরে পূর্ববর্তী অর্থবছরের চেয়ে শুল্ক ছাড়ের পরিমাণ বেশ বেড়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন,‘আমরা ধীরে কর অব্যাহতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছি।
আগের দেওয়া অনেক কর অব্যাহতিও বাতিল করেছি। নতুন করে কোন কর অব্যাহতিই দেওয়া হচ্ছেনা।’ শুল্ক ছাড় বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুল্ক ছাড়ও কমছে। তবে শুল্ক ছাড় বাড়ছে এমনটি ঠিক নয়।’
এনবিআর চেয়ারম্যান সারাবাংলাকে আরও বলেন, গত অর্থবছরে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে চিনি, সয়াবিন তেল এবং চাল। জনগণের সুবিধার জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এটিকে ছাড় না বলে জনগণের স্বস্তি নিশ্চিত করার একটি উপায় হিসেবেই আমরা দেখছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করব। সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক ও কর অব্যাহতি বাদ হয়ে যাবে। আমাদের সব সময় একটা দাবি ছিল যে, এই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন যদি কোনভাবে পেছানো যায়। আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সুযোগটা নিচ্ছি কারণ আমাদের আমদানি ও রফতানির বাজার অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। যেখানে অব্যাহতি প্রয়োজন সেখানে অব্যাহতি তো দিতে হবে। কারণ এর সঙ্গে কর্মসংস্থান ও অনেকগুলো বিষয় জড়িত। অব্যাহতি পেয়ে দেশে অনকে খাত বড় ও স্বনির্ভরশীল হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমেরিকার মতো বড় দেশগুলোও অনেক খাতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যেসব খাত দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে, ভবিষ্যতে ওই শিল্প অনেক বড় হতে পারে, অনেক কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে, সেসব শিল্প বা খাতে কর ও শুল্ক অব্যাহতি দিতে হবে। আমরা তো উন্নত দেশ নয়। এখন একটি শিল্প বা প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে যদি অব্যাহতি তুলে নেওয়া হয় সেটার কি প্রভাব পড়তে পারে, সেই বিবেচনাটা কি রেখেছে কেউ? আইএমএফ এর সব শর্ত মেনে নিলেই যে তা ভালো হবে তা নয়। কিংবা আইএমএফ’র সব শর্ত যে সব সময় ভালো হয় তাও কিন্তু নয়।’
মন্তব্য জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সুনির্দিষ্ট শিল্প বা খাত এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য কিছু কিছু অব্যাহতি দিতে হয়। কোন একটি মেশিন আনছি, এটির উপরে ১৫ শতাংশ ডিউটি, কিন্তু এটি যদি পরিবেশ বান্ধব হয়; তাহলের এর ওপরে আমরা শুল্ক কম রাখবো। সরকার মাঝে মাঝে- তার যেসব অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, যেমন পরিবেশবান্ধব ও দারিদ্র নিরসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমদানি, এসব শিল্পে সরকার মাঝেমধ্যে অব্যাহতি দিয়ে থাকে। দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে এর যৌক্তিকতা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে চেষ্টা করা উচিৎ যৌক্তিক একটি আমদানি শুল্ক কাঠামো প্রণয়ন করা। কারণ অব্যাহতির বিষয়গুলো বেশি থাকলে সেখানে নানা ধরণের অনিয়ম করার সুযোগ থাকে। সুতরাং আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ অব্যাহতিগুলো হ্রাস করা এবং আমদানি শুল্ক কাঠামো যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা।’
কর অব্যাহতি বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেটে সরকার কিছুটা কর অব্যাহতি কমানোর চেষ্টা করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্যেও আগামী বছরের বাজেটে কর অব্যাহতির বড় একটি পুর্নবিন্যাস করত হবে। কর অব্যাহতির যৌক্তিকীকরণ করতে হবে, একেবারে যে অব্যাহতি লাগবেনা; সেটি ঠিক নয়।’ একইভাবে যৌক্তিক শুল্ক ছাড়ের বিষয়টিও থাকতে হবে বলে তার মত।