ঢাকা: সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ঢাকার উপাধ্যক্ষ হাসনাৎ-এর কাছে কলেজের দুই অধ্যক্ষ ধরাশায়ী হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সকল নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কলেজটিতে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অধ্যাপক হয়েও তিনি উপাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ পদটি সহযোগী অধ্যাপকের। গত ৭ আগস্ট কলেজের সর্বশেষ অধ্যক্ষ অধ্যাপক রিজিয়া সুলতানাকে এই পদ থেকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।
এর আগে, গত বছরের ৩০ জুন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ঢাকা থেকে অবসরে যান অধ্যক্ষ মো. গোলাম ফারুক। বিদায়ের দিন উপাধ্যক্ষ প্রফেসর হাসনাৎ জাহানের অপমানের মুখে হাউমাউ করে কেঁদে তিনি অফিস ত্যাগ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এসব অভিযোগ উঠেছে বর্তমান উপাধ্যক্ষ হাসনাৎ জাহানের বিরুদ্ধে। তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এসব কাজ করছেন বলে দাবি কলেজের একাধিক কর্মকর্তা ও শিক্ষকের।
শুধু তাই নয়, উপাধ্যক্ষ পদটি সহযোগী অধ্যাপকের হলেও হাসনাৎ জাহান অধ্যাপক হয়েও এই পদটি আকঁড়ে রেখেছেন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন উপাধ্যক্ষ হাসনাৎ। তিনি বলেন, কাউকে বদলি করার ক্ষমতা আমার নেই। আর মন্ত্রণালয় কেন আমার কথা শুনবে ?
জানা গেছে, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের দ্বন্দ্বে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে (টিটিসি) অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে উঠেছে। কলেজটিতে কোনো পদ না থাকলেও অন্তত আটজন অধ্যাপককে নিয়োগ দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ ঢাকার বাইরে বাকি ১৩টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রায় সব ক’টি কলেজের অধ্যাপকের পদ শূন্য রয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকায় থাকতেই বসে বসে বেতন তুলছেন এসব শিক্ষকরা। তবে এই কলেজটিতে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের দ্বন্দ্বে কলেজ ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি পালটাপালটি অভিযোগের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযান চালিয়েছে। তবে তারা এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি।
জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট টিটিসি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক রিজিয়া সুলতানাকে ওএসডি করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে মাউশিতে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে। তবে অভিযোগ ভিত্তিহীন বলছেন সদ্য ওএসডি হওয়া অধ্যক্ষ রিজিয়া সুলতানা।
১৪ ব্যাচের শিক্ষা কর্মকর্তা রিজিয়া সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে এই পদ থেকে সরানোর জন্য বর্তমান উপাধ্যক্ষ হাসনাৎ জাহান নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করেছেন। এখন তিনি এই কলেজটির অধ্যক্ষ পদে বসতে শিক্ষার দফতরগুলোতে তদবির করছেন। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিন বছর পর বদলির বিধান থাকা সত্ত্বেও হাসনাৎ জাহান এই কলেজটিতে প্রায় ২০ বছর ধরে চাকরি করছেন।’
জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খুলনায় বদলি করা হলেও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হলেন শামসুর নাহার চাঁপার প্রভাব খাটিয়ে পদায়ন নিয়ে ফের ঢাকা টিটিসিতে উপাধ্যক্ষ পদে ফিরে আসেন হাসনাৎ জাহান।
অন্যদিকে, অধ্যক্ষের দেওয়া উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন হাসনাৎ জাহান। তিনি বলেন, ‘সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এগুলো উনি মিথ্যা বানিয়ে বলছেন।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমি দীর্ঘ দিন এই কলেজে থাকলেও কোনো ধরনের অনিয়ম করিনি। এমনকি এই অধ্যক্ষ কোনো কাজ করলেও আমার মতামত নেননি। বরং তার বিরুদ্ধে টিটিসির বাসভবন ইচ্ছে মতো ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি দুই শিক্ষককে বদলি করা নিয়ে ঘটনার জেরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের পর তিনি আমাকে শত্রু মনে করছেন।’ তিনি বলেন, অধ্যক্ষ ড. রিজিয়া সুলতানা সবধরনের পদোন্নতি এই কলেজ থেকেই নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেখানে তারা দুই শিক্ষা ক্যাডারের (রিজিয়া সুলতানা ও হাসনাত জাহান) সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে দুদক কর্মকর্তারা সারাবাংলাকে জানান, দুই নারীর রেষারেষির কারণেই আমরা ওখানে অভিযান চালিয়েছি। দু’জনের সঙ্গেই কথা বলেছি। বিভিন্ন অভিযোগ ছিল, সেসব কাগজ দেখেছি। কিন্তু যেমন অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেভাবে পাওয়া যায়নি। সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকিটা সংশ্লিষ্ট দফতর ব্যবস্থা নেবে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৩ মার্চ তৎকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান শামসুন্নাহার চাঁপা। চাঁপা প্রথম কর্মদিবসে অধ্যাপক হাসনাৎকে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য সচিবকে চাপ দেন। পরে ১১ মার্চ ২০২৪ সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পান প্রফেসর হাসনাৎ জাহান। যিনি টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় কলেজটিতে কর্মরত ছিলেন। এর আগে ২০২৪ সালের ৩০ জুন কলেজ থেকে অবসরে যান অধ্যক্ষ মো. গোলাম ফারুক। বিদায়ের দিন উপাধ্যক্ষ প্রফেসর হাসনাৎ জাহানের অপমানের মুখে হাউমাউ করে কেঁদে তিনি অফিস ত্যাগ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর পর থেকে কলেজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠেন।
সূত্র জানায়, টিচার্স ট্রেনিং ক্যাডারের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সদস্য ১৪তম বিসিএসের অধ্যাপক রিজিয়া সুলতানা ২০২৪ সালের ৭ জুলাই অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পান। প্রথম দিন থেকে উপাধ্যক্ষ তার পিছু নেন। পূর্বতন অধ্যক্ষের মতো এ অধ্যক্ষকে তার কথা মতো পরিচালিত করতে না পেরে তার অনুসারীদের ক্ষেপিয়ে দেন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের ১৩ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি আভিযানিক দল আকস্মিক কলেজ পরিদর্শনে যায়। তাদের সামনে সব তথ্য ও নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়। দলটি এগুলো দেখার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কলেজ প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন। কিন্তু এরপরও উপাধ্যক্ষ হাসনাতের তৎপরতা বন্ধ ছিল না। তার প্রচেষ্টায় ৬ আগস্ট রাতে অধ্যাপক রিজিয়া সুলতানার ওএসডির আদেশ জারি হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ঢাকার উপাধ্যক্ষের পদটি সহযোগী অধ্যাপকের। ২০২৪ সালের মার্চে প্রথম একজন অধ্যাপককে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ পদে পদায়ন দেওয়া হয়। উনি মাঝের দেড় বছর বাদ দিলে ২০ বছর এই কলেজে এবং ২৫ বছর ধরে ঢাকায় চাকরি করছেন। তিনি তার পারিবারিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তটস্ত করে রাখতেন। কথায় কথায় এসিআর ও বদলির ভয় দেখান। কেউ অধ্যক্ষের অনুগত দেখলেই তাকে শাসানো শুরু করেন। গত মে মাসে সহকারী অধ্যাপক জয়দীপ দেকে এই কারণে তিনি বদলি করান। এর আগে তিনি প্রকাশ্যে জয়দীপকে দ্রুত বদলি করে দেবেন বলে হুমকি দেন। কলেজে ১১০০ শিক্ষার্থীদের জন্য এখন ৬০ জন শিক্ষক আছেন। অথচ পদ আছে মাত্র ৩৭টি।
ঢাকা টিটিসিতে একটি অধ্যাপকের পদ আছে। অথচ কর্মরত আছেন আটজন। এরা দীর্ঘকাল এই স্টেশনে থেকে কলেজের প্রশাসনিক কাজে জটিলতা তৈরি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।