ঢাকা: ১৯ জুলাই ২০২৪। দেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত দিন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় জুলাই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর রামপুরাজুড়ে। সেদিন নিজ বাসার সামনে দাদির কোলে বসেছিল ছোট্ট মুসা। হঠাৎই পুলিশের ছোড়া গুলি শিশুটির মাথা ভেদ করে লাগে দাদি মায়া ইসলামের পেটে। কিন্তু মুসা প্রাণে বাঁচলেও পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হয় ৬০ বছরের এ বৃদ্ধাকে। ওইদিন হতাহত হন আরও অনেকে। আর এসব নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিনিময়ে শাস্তির বদলে পুরস্কার পেয়েছেন ‘ঘাতক’ পুলিশ সদস্যরা।
সাধারণত নিরস্ত্র মানুষ হত্যার দায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। অথচ উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে পুরস্কার হিসেবে এক লাখ টাকা দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত রামপুরায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার একটি ফর্মাল চার্জের (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) শুনানিতে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
জানা গেছে, আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহারে শেখ হাসিনার হুকুম যথাযথ পালন করেন হাবিবুর রহমান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেতেই অধীনস্তদের বাস্তবায়ন করতে বলেন তিনি। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছাত্র-জনতাকে গুলি করার আদেশও দেন সাবেক এই ডিএমপি কমিশনার। একইসঙ্গে ডিএমপিতে তার অধীনে কর্মরত সবাইকে হত্যার স্বাধীনতা দেন।
এমন নির্দেশনা পেয়ে ১৯ জুলাই খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে রামপুরায় নির্বিচারে গুলি ছোড়েন পুলিশ সদস্যরা। এর মধ্যে রয়েছেন রামপুরা থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মশিউর রহমান, এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। তাদের গুলিতে শহিদ হন মো. নাদিম। সেদিন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছিলেন এই তরুণ। জুমার নামাজ শেষে বনশ্রী মসজিদ থেকে বের হতেই তাকে গুলি করে পুলিশ। দুটি গুলি তার পেট ভেদ করে বেরিয়ে যায়। এতে মুহূর্তেই হারান প্রাণ তিনি।
একই দিন বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। পুলিশের গুলির ভয়ে বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন তিনি। কিন্তু তার পিছু নেয় পুলিশ। জীবন বাঁচাতে ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন এই যুবক। তবে দেখে ফেলে তার ওপর পর পর ছয় রাউন্ড গুলি করেন এক পুলিশ সদস্য।
এসব ঘটনার দু’দিন পরই রামপুরা থানায় যান কমিশনার হাবিবুর রহমান। সেদিন নির্মম হত্যাকাণ্ডের ব্যবস্থা না নিয়ে গুলি করা পুলিশ সদস্যদের ডেকে নগদ এক লাখ টাকা পুরস্কার দেন তিনি। মূলত মানুষ হত্যার কারণে তিনি তাদের মনে উৎসাহ জোগান বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
ট্রাইব্যুনালে আজ প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার, মঈনুল করিম ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান। এর আগে, ৭ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলার ফর্মাল চার্জ দাখিল করা হয়।
প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে রামপুরায় বহু ঘটনা ঘটেছে। তবে ১৯ জুলাইয়ের তিনটি ঘটনাকে একটি ফর্মাল চার্জের অধীনে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেয় প্রসিকিউশন। ওই চার্জের ওপর আজ শুনানি হয়। শুনানি শেষে পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে একজন কারাগারে রয়েছেন। তাকে আগামী ১৭ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পলাতক চারজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।