ঢাকা: ‘শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ। বয়স ১৪ বছর। একমাত্র ছেলে হওয়ায় আদরের ছিল মা-বাবার। কিন্তু চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই দিতে হলো প্রাণ। পুলিশের গুলিতে প্রাণ যাওয়ায় হাসপাতালের চিকিৎসকরাও স্বজনদের সঙ্গে করেন অসদাচরণ। এমনকি লাশ ফেলে দিতে চেয়েছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীতে।’ শহিদ হওয়ার পর ছেলের লাশ নিয়ে সেদিনের চিকিৎসকদের এমন পীড়াপীড়ির কথা জবানবন্দিতে তুলে ধরেন শেখ জামাল হাসান।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষী দিতে এসে অঝোরে কাঁদলেন এই বাবা। মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। এদিন তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই বিচারপতির ট্রাইব্যুনাল।
ছেলের স্মৃতির কথা তুলে ধরে বারবারই সাক্ষীর ডায়াসে কান্নায় ভেঙে পড়েন জামাল। তবে কোনো ধরনের অনুশোচনার চাপ দেখা যায়নি এ হত্যাযজ্ঞের অন্যতম হোতা কনস্টেবল সুজনের মুখে। উল্টো চোখে ছিল হাসির ঝিলিক। এদিন দুপুর আড়াইটার পর সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন শেখ জামাল হাসান। এর পর নিজের পরিচয় দিয়ে গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে চানখারপুলে ঘটে যাওয়া পুরো বর্ণনা তুলে ধরেন।
জামাল বলেন, ‘আমি এখন অবসর জীবনযাপন করছি। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ। বয়স ১৪ বছর। মেয়েটা বড়। ছেলেটা সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। চব্বিশের জুলাইয়ের শুরু থেকেই পরিবারসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম আমি। আমার স্ত্রী-সন্তানরা অনেকটা সক্রিয় ছিলেন। ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক পৌনে ১১টায় নিজের বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় আমার ছেলে জুনায়েদ। আমরা তখন বাসায় ছিলাম। আমার স্ত্রী-মেয়েও বাসা থেকে বের হয়ে যান। তারা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেন।’
দুপুর ঠিক পৌনে ২টার দিকে জামালের মুঠোফোনে রিংটোন বেজে ওঠে। কল ধরতেই তার শ্যালক আসিফ বলেন- ‘জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’ আর এমন খবর পেতেই ছেলেকে খুঁজতে বাসা থেকে বেরিয়ে যান পাগলপ্রায় বাবা। রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ধুপখোলা মাঠসহ আজগর আলী হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেন। এর মধ্যেই দুপুর ২টার দিকে মোবাইল ফোনে আরেকটি কল। এ কলটি জামালের ভাতিজির। ‘জুনায়েদের লাশ বাসায় এসেছে’ খবর দিয়ে বলা হয় বাসায় ফেরার কথা। বাসায় যেতেই দেখেন ভাই আব্দুর রহমানের ফ্ল্যাটে ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার বাম চোখে গুলি লেগে মাথার পেছন দিকে বড় গর্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে।
জুনায়েদের বাবা বলেন, ‘ছেলের বন্ধু সিয়ামসহ আরও কয়েকজনকে আমার ভাইয়ের ফ্ল্যাটে দেখি। পরে তারা জুনায়েদের মৃত্যুর ঘটনা খুলে বলে। আমাকে সিয়াম জানায়- শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের দিক থেকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। পরে তারা কয়েকজন ছাত্র মিলে রিকশায় করে আমার ছেলেকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।’
ওইদিন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা বলেন, ‘মরদেহ নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে মরদেহ হাসপাতালে রাখা যাবে না। তাড়াতাড়ি না নিয়ে গেলে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে দেওয়া হবে। বুড়িগঙ্গায় মরদেহ ফেলে দেওয়ার কথাও বলেন তারা।’ চিকিৎসকদের পীড়াপীড়িতে দ্রুত আমার ছেলের লাশ বাসায় নিয়ে আসে তারা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘১৪ বছর বয়সী ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মতো জীবনযাপন করছি আমি ও আমার স্ত্রী। আমার ছেলে ১০ পারা কোরআনের হাফেজ ছিল। কী দোষ ছিল ওর। ছেলে হারানোর বেদনায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। ওরা আমাকে কেন গুলি করে মারল না।’
জবানবন্দিতে এই সাক্ষী বলেন, ‘আমি শুনেছি সুজন আমার ছেলেকে গুলি করেছে। আমি যখন আমার ছেলেকে দেখি তখনও তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার ছেলেকে গুলি করার ভিডিও আমার কাছে আছে। আমি আসামিদের বিচার চাই। তাদের ফাঁসি চাই।’
এ সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আরও অনেক নির্দেশদাতার কথাও বলেন তিনি।