Wednesday 13 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উপদেষ্টা আসিফের জবানবন্দি
‘প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখানোর কথা বলে নেওয়া হয় ভিডিও বার্তা’

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৩ আগস্ট ২০২৫ ২২:২৭

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: চব্বিশের ১৯ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল পুরো দেশ। বন্ধ ইন্টারনেট। বাটন ফোনই যোগাযোগের একমাত্র সম্বল। আর এই ফোনকলেই কথা চালাচালি করতেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করা। তাদেরই একজন বর্তমান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। প্ল্যাটফর্মের প্রথম সারিতে থাকায় গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন সবচেয়ে বেশি। ফলে শেষমেশ হন গুমের শিকার। এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখানোর কথা বলে জোর করে ভিডিওবার্তা নেন ডিবি কর্মকর্তারা।

মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে দেওয়া আসিফ মাহমুদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এমন তথ্য। নিজেকে তুলে নেয়াসহ ‘আয়নাঘর’ বা ডিবি হেফাজতে থাকা নির্যাতনের কথার বিবরণও দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম এই সমন্বয়ক। দিয়েছেন অন্য সব সমন্বয়কের বর্ণনাও।

বিজ্ঞাপন

গুম প্রসঙ্গে জবানবন্দিতে আসিফ বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাতে গুম হওয়ার আশঙ্কায় আমি গুলশান থেকে স্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করছিলাম। ওই সময় সারাদেশে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন থাকায় ফোনকলেই যোগাযোগ করছিলাম আমরা। সম্ভবত এ সুযোগে মোবাইল ট্র্যাক করে আমাকে তুলে নেয় ডিজিএফআই। ওই রাতে নাহিদ ভাইকেও গুম করা হয় বলে পরবর্তী সময়ে জানতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমি বুঝতে পারিনি কোথায় আনা হয়েছে। তবে চোখ খুলে যে কক্ষে নিজেকে দেখতে পাই, সেই কক্ষটা দেখে মনে হয়নি যে I have a bed room। সরকার পরিবর্তনের পর ক্যান্টনমেন্টে ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর পরিদর্শনে গেলে বুঝি যে, ‘আমাকেও সেখানেই রাখা হয়েছিল।’

আসিফ মাহমুদ বলেন, “সাংবাদিক তাসনীম খলিলের ভাষ্য অনুযায়ী- আমাকে রাখা কক্ষটি ছিল তথাকথিত ‘ভিআইপি’ সেল। যেখানে দুটি এক্সস্ট ফ্যান ছিল। তুলনামূলকভাবে একটু ‘ভালো’ পরিবেশ। আমি ১৯ জুলাই (শুক্রবার) থেকে ২৪ জুলাই (বুধবার) পর্যন্ত চারদিন গুম ছিলাম। মুক্তি পাওয়ার পর আমি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। সেখানে নাহিদ ভাইও চিকিৎসারত ছিলেন। তবে আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে ছিলাম। উপস্থিতি ছিল সব গোয়েন্দা সংস্থার।’

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অন্যমত এই সমন্বয়ক বলেন, “কোটা আন্দোলনকারীদের দাবির অনুকূলে সরকার একটি রায় দিয়েছে বলে পরবর্তীতে জানতে পারি। তবে আন্দোলনের শুরু থেকেই একটি পক্ষ ‘নেগোশিয়েশন’র চেষ্টা করছিল। বিশেষত ডিজিএফআইয়ের কর্নেল তারেক, কর্নেল সরোয়ার ও ইন্টারনাল এফআইএস ব্যুরোর ব্রিগেডিয়ার লেভেলের এক কর্মকর্তা। যিনি ভিন্ন নামে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাদের পাশাপাশি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডিএমপির ক্রাইম ডিভিশন ও সিটিটিসির একটি অংশও সালাপের উদ্যোগ নেয়।’

‘আমাদের কাছে শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসানের সঙ্গে নিজের কথোপকথনের স্ক্রিনশট দেখিয়ে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘সরাসরি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। আমাদের সহযোগিতা করলে সমস্যার সমাধান হবে। তবে এসব আলোচনার আড়ালে তারা আমাদের ওপর কড়া নজরদারি ও চাপ প্রয়োগ করছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘২৫ জুলাই দুপুরে হাসপাতালে আমাদের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আন্দোলন স্থগিতের চাপ দেওয়া হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভিডিওবার্তা দিতে অস্বীকৃতি জানাই। পরে তারা আমাকে দু’তিনবার লাথি মারে। পরদিন ২৬ জুলাই আমাদের টানাহেঁচড়া করে হাসপাতালে থেকে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও বলা হয়েছিল যে, আমাদের ইম্পালস হাসপাতালে নেওয়া হবে।’

‘পরদিন হাসানাত ভাই-সারজিস ভাইকেও তুলে আনা হয়। আর রাতে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয় নুসরাতকে। তাকে আনার পরে আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। এ ছাড়া, আমার চিকিৎসা চলমান থাকলেও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে কেবল প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুষ আনা হয়।’

জবানবন্দিতে আসিফ বলেন, “বারবার আবু বাকের মজুমদারকে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করতেন রমনা জোনের এডিসি ফজলে ইলাহী (যার বাড়ি চাঁদপুর)। রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন আমাদের ব্ল্যাকমেইল করে বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের নামে মামলা হচ্ছে। আমাদের পরিবারকেও টার্গেট করা হবে। এ ছাড়া, প্রতি দু’দিন পর পর আমাদের ডিবিপ্রধান হারুনের কাছে হাজির করাতেন। সেখানেও আমাদের মামলায় জড়ানোর হুমকি দেওয়া হতো। আমরা ভিডিওবার্তা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বলা হয়, কেবল প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখানোর জন্য একটি ভিডিও প্রয়োজন।’

‘ডিবি কার্যালয়ে ছয়দিন আটক রেখে জোর করে আমাদের একটি ভিডিও স্টেটমেন্ট দিতে বাধ্য করা হয়। আমাদের সাক্ষ্য ও সই দিতে বাধ্য করেন রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন। আমরা ভেবেছিলাম, বাইরে গিয়ে প্রেস ব্রিফিং করব। এ ছাড়া, ডিবি কার্যালয়ের ভেতরে এক ব্যক্তির মাধ্যমে আমাদের ভিপি নূরের সঙ্গে দেখা করানো হয়। তাকে সেখানে মারধর করা হয়। আহত অবস্থায় আমরা তাকে দেখতে পাই।’

জবানবন্দিতে আসিফ বলতে থাকেন, ‘পরবর্তী সময়ে আমি ও নাহিদ ভাই অনশন শুরু করি। সেটা শুনতে পেয়ে বাকিরাও অনশন শুরু করেন। শেষবার যখন ডিবি প্রধান হারুনের কক্ষে উপস্থিত করা হয় আমরা সেখানেও অনশনে বসি। তখনও সারাদেশে আন্দোলন চলছিল। আমাদের অনশনের খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের উদ্ধার করতে সম্মিলিতভাবে ডিবি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। ভেতরে অবস্থানকালে আমরা কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝে কনস্টেবলের মাধ্যমে পত্রিকা চাইলেও একদিন ছাড়া আর কোনো সংবাদপত্র কিংবা কোনো তথ্য আমাদের হাতে পৌঁছায়নি।’

উপদেষ্টা আসিফ বলেন, “২০২৪ সালের ১ আগস্ট দুপুরে ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্ত হওয়ার পর প্রথমেই আমরা আন্দোলনের পরিস্থিতি জানতে চাই। আমরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি। তখন রিফাত, মাসুদ, মাহিম, কাদেরসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। পরদিন আমাদের একটি পদযাত্রা হয়। যেখানে সবাইকে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। ৩ আগস্ট আমরা আন্দোলনের গতি নির্ধারণে ‘একদফা’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিই এবং কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে তা ঘোষণা করি। ঠিক কতদিন আন্দোলন চলবে তা তখনও নিশ্চিত ছিলাম না।”

উল্লেখ্য, চানখারপুলে আনাসসহ ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। তৃতীয় দিনের মতো আজ সাক্ষ্যগ্রহণ-জেরা শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ছয়জন সাক্ষী নিজেদের জবানবন্দি দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২০ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আর এ মামলার অন্যতম সাক্ষী হিসেবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও সাক্ষ্য দেবেন বলে জানা গেছে।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া জবানবন্দি প্রধানমন্ত্রী ভিডিও বার্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর