রংপুর: রংপুরের তারাগঞ্জে গণপিটুনিতে দলিত সম্প্রদায়ের দুইজনকে হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা আর মব সৃষ্টিকারীদের অতি উৎসাহীপণাকে দায়ী করছেন পরিবার, স্বজন ও স্থানীয়রা। তারা বলছেন, সেদিন পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি দেখে থানায় ফিরে না গিয়ে মব সৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করতে পারলে রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে বাঁচানো যেত।
নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানীর ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, গণপিটুনির সময় রূপলাল হাত জোর করে, পা ধরে বাঁচার আকুতি জানালেও কেউ এগিয়ে আসেনি; কিন্তু এখন আসছেন অনেকেই যা তিনি মানতে পারছেন না।
তাই এ ঘটনাকে পুরোপুরি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আখ্যা দিয়ে পরিবারের দাবি, অনতিবিলম্বে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা না করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করার।
উত্তরের জেলা রংপুরের উপজেলা তারাগঞ্জ। উপজেলার বকুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা রুপলাল দাস এবং তার একজন নিকটাত্মীয় মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস দলিত সম্প্রদায়ের এই দুই ব্যক্তিকে গত ৯ আগস্ট ‘ভ্যান চোর সন্দেহে’ পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে রূপলাল দাস পেশায় মুচি এবং প্রদীপ দাস পেশায় ভ্যানচালক। তারা পরস্পরের আত্মীয়।
ঘটনার আদ্যোপান্ত—
পুলিশ, নিহতদের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ঘটনাস্থল সম্পর্কে অবগত— এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর দাসের জন্য বিয়ের আলোচনা হচ্ছিল মিঠাপুকুর উপজেলার এক পরিবারের সঙ্গে। ১০ আগস্ট রোববার এ বিষয়ে দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার কথা। এ বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান নিয়ে কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুরে রূপলাল দাসের বাড়িতে আসছিলেন প্রদীপ দাস। কিন্তু তারাগঞ্জ উপজেলা সয়ার ইউনিয়নে এসে কুর্শা যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে তিনি রূপলাল দাসকে ফোন করেন।
রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর দাস জানান, আমার মামাতো বোন জামাইবাবুকে (প্রদীপ দাস রূপলাল দাসের ভাগ্মী জামাতা) আনতে বাবা বের হয়ে যান। জামাইবাবুর ভ্যানেই তারা বাড়ির দিকে আসছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্যান কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় এলে তাদের কয়েকজন থামান এবং এরপরই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে, যাতে দুইজনই গুরুতর আহত হয়ে মারা যান।
তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে জমায়েত হওয়া ব্যক্তিরা আমার বাবা রূপলাল দাস ও বোন জামাই প্রদীপ দাসকে ‘ভ্যান চোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। বাবা এ সময় তাদের বিষয়ে জানার জন্য বারবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বা মেম্বারকে ফোন দিতে বলেন কিন্তু জড়ো হওয়া ব্যক্তিরা কোনো তোয়াক্কা করেননি। আমার বাবা হাত জোর করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন কিন্তু নিষ্ঠুর, নির্দয় মনের মানুষেরা শোনেননি। তিনি বার বার বলছিলেন ‘আমি চোর না, আমি ডাকাত না, আমি জুতা সেলাই করি’, কিন্তু কেউ শোনেননি।’’

তারাগঞ্জে গণপিটুনির সময় নিহত রূপলাল দাস ও প্রদীপ লাল হাতজোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চান। ছবি: সংগৃহীত
স্থানীয় এক ব্যক্তি সারাবাংলাকে জানান, এরমধ্যেই আরও লোকজন জমায়েত হয়ে তাদের গণপিটুনি দিতে শুরু করে এবং মারতে মারতেই বুড়িরহাট স্কুলের মাঠে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা জ্ঞান হারালে হামলাকারীরা চলে যায়। এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পরই চিকিৎসকরা রূপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। আর রোববার সকালে মারা যান প্রদীপ দাস। তাদের মৃত্যুর খবরে কুর্শা ইউনিয়নের লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
কেন এই পরিস্থিতি?
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র বলেছে, উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের দোলাপাড়া গ্রামে গত ২৫ জুলাই রাতে এক পরিবারের সদস্যদের বেঁধে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোটরসাইকেল নিয়ে যায় ডাকাতেরা। এর পরপরই ২৮ জুলাই বকশিপাড়া গ্রামে একজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা ভ্যান নিয়ে যায়। ২ আগস্ট দীঘলটারী গ্রামে দুটি গরু, কয়েক দফায় অটোরিকশা চালকদের অচেতন করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন স্থানীয় লোকজন। ৩ আগস্ট থেকে চোর ধরতে এলাকাবাসী রাত জেগে পাহারা শুরু করেন।
সেদিন রাতে রূপলাল ও প্রদীপ দাসের ভ্যান বটতলা এলাকায় আসার পর কয়েকজন লোক ভ্যান ঘিরে ধরে। তারা ওই ভ্যানে রাখা একটি বস্তা থেকে কয়েকটি বোতল বের করেন এবং এসব বোতলে চোলাই মদ রাখার অভিযোগ করেন। জানা গেছে, দলিত সম্প্রদায়ের অনেকে নিজেদের ঘরে তৈরি চোলাই মদ সেবন করে থাকেন। এটি এই সম্প্রদায়ের অনেকে স্বাভাবিক জীবনাচরণের অংশ বলেও মনে করে থাকেন। ভ্যানের বোতলে থাকা তরল পদার্থের ঘ্রাণ নিয়ে কয়েকজন তাৎক্ষণিক অসুস্থ বোধ করার দাবি করলে উপস্থিত অন্যরা আরও মারমুখী হয়ে ওঠে।
তবে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, রূপলাল ও প্রদীপ দাসের ভ্যান বটতলায় পৌঁছার আগেই সেই ভ্যানে তিনজন নারী ছিলেন। বটতলায় আসার পর তিন নারী ভ্যান থেকে নেমে যান এবং এরপর তারাই কাছে থাকা স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার পর লোকজন ভ্যানটি ঘিরে ধরে ‘ভ্যান চুরি’ ও ভ্যানে চোলাই মদ রাখার অভিযোগ করে মারতে শুরু করেন।
নিহত রূপলালের ছেলে জয় দাসের অভিযোগ, উৎসবে তারা বাংলা মদ খান। শ্যালিকার বিয়ে উপলক্ষ্যে প্রদীপ লাল ছোট বোতলে করে সেগুলো নিয়ে আসছিলেন। বটতলায় তার বাবা ও দুলা ভাইকে আল-আমিন, এবাদতসহ কয়েকজন আটক করে সেই বোতলগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পথচারীরা জড়ো হন।
তিনি বলেন, ‘লোকজন জড়ো হলে তারা বাবা আর দুলাভাইকে চোর বলতে থাকে। এরপর লোকজন মারধর শুরু করে। পাশের ফরিদাবাদ গ্রামের মেহেদী হাসান বস্তা থেকে বোতল বের করে ছিপি না খুলেই নাকে নিয়ে অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করেন। এরপর উত্তেজিত লোকজন বাবা-দুলাভাইকে মারধর করে মেরে ফেলে।’
পুলিশ এসে ফিরে যায়
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যখন বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে নেওয়া হয়, তখনও তারা জীবিত ছিলেন। চোর ধরা পড়েছে খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানে মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। এর কিছুক্ষণ পরে বুড়িরহাট বাজারে পুলিশের দুটি ভ্যান আসে। তারা রূপলাল ও প্রদীপকে উদ্ধার না করে ফিরে যায়। এরপর প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি পৌঁছায়।
প্রত্যক্ষদর্শী বুড়িরহাট বাজারের সবজি বিক্রেতা খোকন মিয়া বলেন, ‘দুইটা পুলিশের গাড়ি আসে কিন্তু অনেক লোক দেখে তারা ফেরত যায়। আবার ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ, সেনাবাহিনীর তিনটা গাড়ি আসে। তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী দামোদরপুর পণ্ডিতপাড়ার ভ্যানচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ এসে বাঁশি ফুকিয়ে চলে যায়।’
সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল হামিদ বলেন, ‘পুলিশ চাইলে দুইজনকে বাঁচাতে পারতো।’
নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে তারাগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ‘থানা থেকে বুড়িরহাট অনেক দূর। যখন মব তৈরি হয়, তখন স্কুল মাঠে তিন-চার হাজার মানুষ অবস্থান নিয়েছিল। তাদের নিবৃত করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি।’
নিহতের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ও পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার
রংপুরের পুলিশ সুপার আবু সাইম জানান, এ ঘটনায় নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী রোববার দুপুরে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ওই রাতে বালাপুর এলাকার এবাদত হোসেন (২৭), বুড়িরহাট এলাকার আক্তারুল ইসলাম (৪৫), রফিকুল ইসলাম (৩৩) ও রহিমাপুরের মিজানুর রহমানকে (২২) গ্রেফতার করে পুলিশ।
আরও পড়ুন- দায়িত্বে অবহেলায় ৬ পুলিশ প্রত্যাহার, তদন্ত কর্মকর্তা বদল
তিনি জানান, এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক উপপরিদর্শক (এসআই) ও ছয় কনস্টেবলকে (সদস্য) তারাগঞ্জ থানা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। প্রত্যাহারের পর তাদের পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যাহার পুলিশ সদস্যরা হলেন— তারাগঞ্জ থানার এসআই আবু জোবায়ের, রংপুর পুলিশ লাইনস থেকে যুক্ত থাকা এসআই সফিকুল ইসলাম।
ছয় পুলিশ সদস্য হলেন- ফারিকিত আখতার জামান, ধিরাজ কুমার রায়, হাসান আলী, ফিরোজ কবির, মোক্তার হোসেন ও বাবুল চন্দ্র রায়।
মামলা নিয়ে প্রশ্ন
তারাগঞ্জ থানায় ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা রেকর্ডের পর পুরো এলাকা গ্রেফতার–আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। তারাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান শিপু বলেন, ‘যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, উসকানি দিয়েছে, সরাসরি ওই দুই ব্যক্তিকে মেরেছে তারাই অপরাধী। অনেকে তো বাঁচাতে গেছে, তাদের অপরাধী বলা যাবে না। এলাকার মানুষ যদি দোষী হয়, তাহলে প্রথমে পুলিশই দোষী। কেননা, দুই ভ্যান পুলিশ এসে বাঁচায়নি, পালিয়ে গেছে। অহেতুক ৭০০ জনের নামে মামলা— এটা কি ব্যবসা করার জন্য? মানুষকে আতঙ্কে রেখে টাকা নেওয়ার সুযোগ আমরা দেব না।’
তারাগঞ্জ থানার অফিসার আনচার্জ (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ‘ঘটনাস্থলে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন। এর বিপরীতে সেখানে চারজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তারা তাদের (রূপলাল ও প্রদীপ) বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পেছন থেকে যখন পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি, ঘুসাঘুসি শুরু হয় তখন তারা জীবনের ভয়ে সরে এসেছেন। পুলিশের করার কিছু ছিল না। প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
‘গণপিটুনির সময় কেউ এগিয়ে আসেনি, এখন আসছেন অনেকেই’
নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী স্বামী হারিয়ে বাকরুদ্ধ। দিনের মধ্যে একাধিকবার জ্ঞান হারান। শোকে মুহ্যমান। একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন রূপলাল। এরইমধ্যে রুপলালের মেয়ের বিয়ের জন্য এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। রূপলালের বাড়িতে গিয়ে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়সহ অনেকেই।
আরও পড়ুন- রংপুরে চোর সন্দেহে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ৪