Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি ও পতনের গল্প


২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১০:০৪

তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

স্বাধীন সত্তায় সম্মৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৩ সালের ৩ জুন হিসাবের খাতা খুলে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক। মোট ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে ৪০১ কোটি ৬১ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে ব্যাংকটি।

শুরুতেই ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের নাম আকৃষ্ট করে আমানতকারীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মুনতাসীর মামুন, ক্রিকেটে লগ্নিকারী নাফিসা কামাল, ছাত্রলীগ নেতা সিদ্দিকী নাজমুল আলম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতা মো. মাহবুবুল হক বাবুল চিশতীর সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নাম থাকায় ফারমার্স ব্যাংকে অর্থসঞ্চয় করতে ভরসা পায় অনেকে। তবে তাদের বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করতে খুব বেশি দিন সময় নেননি ব্যাংকটির উদ্যোক্তারা!

লাগাম ছাড়া দূর্নীতি, ঋণ দিতে অনিয়ম ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে লেনদেন শুরুর চতুর্থ বছরে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল ব্যাংটির কার্যক্রম, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারী এবং ব্যাংকটিতে চাকরি করা সাধারণ ব্যাংকাররা।

ফারমার্স ব্যাংকের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করলে জানা যায়, ব্যাংকটিতে এক বছর ধরে তারল্য সংকট চলছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমানতকারীর দায় পরিশোধের সক্ষমতাও নেই ব্যাংকটির। অর্থ সংকটের কারণে কলমানি ও আন্তঃব্যাংক থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে। গত এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টানা নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংক।

নগদ জমা সংরক্ষণে ব্যর্থতার কারণে গত বছরের অক্টোবর থেকে ব্যাংকটিকে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনিয়ম ঠেকাতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ব্যাংকটির শাখা সম্প্রসারণ ও ঋণ বিতরণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বর্তমানে ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত রয়েছে পাঁচ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। আন্তঃব্যাংক আমানত রয়েছে ৫৩৫ কোটি এবং কলমানি থেকে ধারের পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। গত জুনে ব্যাংকটির ৩০৬ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ হার নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত না করে উদ্দেশ্যবহির্ভূতভাবে ঋণ, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ এবং জেনেশুনেও খেলাপি গ্রাহককে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। ঋণ বিতরণে নিজস্ব নীতিমালাও মানা হয়নি। একক গ্রাহকের সর্বোচ্চ সীমা অমান্য করে বড় ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এসব কারণে ব্যাংকটির আর্থিক খাতে ‘নিয়মতান্ত্রিক ঝুঁকির’ সৃষ্টি হয়। এতে করে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে সঞ্চয়কারীদের দায় পরিশোধের সক্ষমতা হারায় প্রতিষ্ঠানটি। এতে আমানতকারী ও ব্যাংকের মধ্যে তৈরি হয় আস্থার সংকট। ফলে জমা করে রাখা অর্থ তোলার চাপ বাড়ে এবং ব্যাংকিং কার্যক্রমে অবনতি ঘটে।

পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী। পরিচালক পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তারা। সবশেষ গত সপ্তায় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংক কোম্পানি আইন জানাচ্ছে, চলতি এই সংকট সমাধানে ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাতে করে ব্যাংকটির পুরো দায়িত্ব চলে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। পরিস্থিতির উত্তরণ হলে উদ্যোক্তাদের হাতে ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব ফিরে যাবে।

বিজ্ঞাপন

তবে এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগুচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে ফারমার্স ব্যাংকের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করবে। এরপর প্রশাসক বসাতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে। প্রশাসক দেওয়ার পর বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রেখে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করার পরিকল্পনাও করছে। এছাড়াও অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচানো যায় কিনা, সেই পরিকল্পনাও করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন পরিকল্পনার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান ও সালেহউদ্দিন আহমেদ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এখনই ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার ব্যপারে জোর দিয়েছেন। দেরি হয়ে গেলে অন্য ব্যাংকগুলোতেও এই সংকটের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী অবশ্য মনে করছেন ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ করে দিলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম বন্ধে দুর্দান্ত উদাহরণের সৃষ্টি হবে।

ব্যাংকটিকে বন্ধ করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা ভাবছেন না অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ফারমার্স ব্যাংকে টিকিয়ে রেখে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মাধ্যমেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় বলে মনে করছেন প্রবীণ এই মন্ত্রী।

তবে ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়মের ঘটনায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী সংসদীয় কমিটি। ব্যাংক দুটির ঋণ অনিয়মের ঘটনা শিউরে ওঠার মতো এবং আর্থিক খাতকে ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছেন কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক। সার্বিক অনিয়মের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশও নিয়েছে সংসদীয় কমিটি।

এ ব্যপারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, নিয়ম মেনেই ব্যবস্থা গ্রহণ হবে বলে জানান তিনি। অপর দিকে, ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে কিনা জানতে চাইলে, বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে, ফারমার্স ব্যাংকটির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর ব্যাংকে তার অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টায় আরো শেয়ার কিনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুমতি চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে সাবেক এই সরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার মোবাইল ফোন সংযোগটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সারাবাংলা/টিএস/এমএম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ঢাকার পথে প্রধান উপদেষ্টা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩৩

সম্পর্কিত খবর