Friday 15 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তিস্তা এখন কানায় কানায় পূর্ণ, বড়ধরনের বন্যার আশঙ্কা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৫ আগস্ট ২০২৫ ০৮:১১ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৫ ০৯:২০

তিস্তা এখন কানায় কানায় পূর্ণ। ছবি: সারাবাংলা

রংপুর: ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও গজলডোবা গেটের সবকটি গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের তিস্তার ১৫২ কিলোমিটারের নিম্নাঞ্চল এখন পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। ডুবে গেছে ফসলি খেত, বড়ধরনের বন্যার শঙ্কায় পাড়ের বাসিন্দারা।

এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে লালমনিরহাটের দোয়ানিতে অবস্থিত ডালিয়া ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো। কর্মকর্তারা বলছেন, ঢল এবং ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে বড়ধরনের বন্যা দেখা দিবে এই অঞ্চলে। তাই সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে পাউবো। আর বিভাগীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা বলছেন, সবপ্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ৫২ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যা বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। পরিস্থিতি সামাল দিতে ও ব্যারেজ রক্ষায় ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী ও অতিভারী বৃষ্টির তথ্য দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।

এদিকে তিস্তার মতো ধরলা, ব্রক্ষপুত্র নদেরও একই অবস্থা। এরই মধ্যে তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ছাড়াও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। হাজার হাজার হেক্টর জমির বাদাম, পাট ও সদ্য রোপিত আমন ধানের জমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শত শত পুকুর তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সঙ্গে সমানতালে চলছে ভাঙন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়বে এই অববাহিকা।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব আরও জানান, এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীগুলোর পানি সমতলে বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এরই মধ্যে তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এতে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম জেলার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ এবং সরেজমিনে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলে পানি উঠছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান জানান, ২৪ ঘণ্টায় দেশের অভ্যন্তরে পঞ্চগড়ে ২০০ মিলিমিটার, রংপুরে ৫৬ মিলিমিটার এবং উজানে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহারে ১০ দশমিক ৫ ও আসামের গোয়াহাটিতে ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে।

তিনি আরও জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের অভ্যন্তরে রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ বিভাগগুলোতে ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, এমন পরিস্থিতিতে এই পাঁচ জেলার চরাঞ্চলের ২২৫টি গ্রামে বন্যার পানি ঢোকে ও প্রায় ২ লাখ মানুষ প্লাবিত হয়। এরই মধ্যেই তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাড়ি-ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলগুলো থেকে মানুষজন বাড়ি-ঘর ছেড়ে গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে চলে যাচ্ছেন।

জানা গেছে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের রাস্তা, ব্রিজ ভেঙে চরসহ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। পানিবন্দি পরিবারগুলো ছোট শিশু, বৃদ্ধ ও গরু, ছাগল, হাস-মুরগি নিয়ে ভয়াবহ বিপাকে পড়েছেন। আত্মীয় স্বজনদের দেওয়া ও শুকনো খাবারই একমাত্র ভরসা পানিবন্দিদের। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পানি বাড়া-কমার সঙ্গে সঙ্গে অববাহিকাগুলো জুড়ে চলছে ব্যাপক ভাঙন। তিস্তা, ধরলাসহ এই অঞ্চলের অববাহিকাগুলোর অন্তত ১০৮টি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ছোট বড় ভাঙন। অনেকস্থানে ভাঙন ঠেকানোর কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুরে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সড়ক সেতুর পশ্চিম তীরে সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ধসে পড়েছে। এতে বাঁধে প্রায় ৭০ ফুট গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা সেতুর পশ্চিম পাশের প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ সেতু রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানছে তীব্র স্রোতের ধাক্কা। বাঁধের নিচের মাটি ধুয়ে গিয়ে ব্লকগুলো ধসে পড়ছে। বর্তমানে বাকি ব্লকগুলোও ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের ক্ষিপ্ত শব্দে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে লালমনিরহাট–রংপুর সড়কসহ পার্শ্ববর্তী হাজারের বেশি পরিবার। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পুরো বাঁধ ভেঙে গিয়ে সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

এদিকে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যার আশঙ্কা করছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়ন, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর ইউনিয়ন এবং পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর, দ্বীপচরের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যার আশঙ্কায় অনেকে ঘরবাড়ি নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।

গজঘন্টা ইউপি চেয়ারম্যান (প্যানেল) বকুল মিয়া জানান, ইউনিয়নের কালির চর, চর ছালাপাক ও চর রাজবল্লভ এলাকার প্রায় ১৫০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কোলকোন্দ ইউপি চেয়ারম্যান (প্যানেল) শরিফুল ইসলাম জানান, ইউনিয়নের বিনবিনা, শখের বাজার, খলাইর চর, মটুকপুর, আবুলিয়া, চিলাখাল এলাকার প্রায় ২৫০ পরিবার পানিবন্দি। মর্নেয়া ইউপি প্রশাসক মাহমুদুর রহমান জানান, ইউনিয়নের চর মর্নেয়া, নরসিংহ, রামদেব, কামদেব, নিলারপাড়া এলাকার প্রায় ৩৫০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নোহালী ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ আলী জানান, ইউনিয়নের চর নোহালী, চর বাগডহরা, চর বৈরাতি, মিনার বাজার, ব্রিফ বাজার ও আশ্রয়ণ বাজার এলাকার নিম্নাঞ্চলের প্রায় ২৫০ পরিবার পানিবন্দি।

আলমবিদিতর ইউপি প্রশাসক আবতাবুজ্জামান জানান, ইউনিয়নের পাইকান হাজীপাড়া ও ব্যাঙপাড়া এলাকার প্রায় ৫০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় ফসলি জমি, বাড়িঘর, মাছ চাষের পুকুর, রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। লক্ষিটারী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল হাদী জানান, ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি, মধ্য ইচলি, পূর্ব ইচলি, জয়রাম ওঝা, শংকরদহ ও চল্লিশ সাল এলাকার প্রায় ৫০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে চরম বিপাকে পড়েছে।

অন্যদিকে গত কয়েকদিনে পীরগাছা উপজেলার তিস্তা নদী বেষ্টিত ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেবসহ আশপাশের এলাকায় শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শুধু শিবদেব গ্রামেই সাম্প্রতিক ভাঙনে কমপক্ষে ৫০টি বসতবাড়ি, একটি ইবতেদায়ি মাদরাসা ও একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিস্তার ভাঙনে হারিয়ে গেছে। নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ পরিবারের মাঝে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে এক বান্ডিল ঢেউটিন ও নগদ তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষীটারী ইউনিয়নের বন্যাকবলিত পশ্চিম ইচলী ও শংকরদহ গ্রাম এবং মর্নেয়া ইউনিয়নের নিলারপাড় এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, ‘বন্যায় তিস্তার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

পাউবো উত্তরাঞ্চলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, যেসব স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে সেখানে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সরকারি স্থাপনা থাকলে গুরুত্ব দিয়ে আপদকালীন কাজ করা হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সারাক্ষণ নদী পাড় মনিটরিং করছেন।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানান, এই অঞ্চলের তিস্তা পানি পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অন্যান্য জেলাগুলোর নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়ার আশঙ্কায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রকল্প কর্মকর্তাদের এরই মধ্যেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা পানিবন্দি হয়ে পড়বেন তাদের দ্রুত যেন উঁচুস্থানে অথবা আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পানিবন্দি মানুষের তাৎক্ষণিকভাবে খাবার দেওয়ারও ব্যবস্থা করবেন তারা।

সারাবাংলা/পিটিএম

কানায় কানায় তিস্তা পূর্ণ বন্যার আশঙ্কা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর