Monday 18 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যশোরের খাল: সরকারি নথি থেকে মানচিত্র, সবখানেই অস্তিত্বহীন!

তহীদ মনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৭ আগস্ট ২০২৫ ০৮:০৪ | আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২৫ ১১:১১

যশোর: যশোরের অনেক খাল আজ বিলুপ্ত। সরকারি দপ্তরের নথিপত্র থেকে শুরু করে মানচিত্র, সব জায়গা থেকেই যেন মুছে গেছে এসব খালের অস্তিত্ব। এমনকি, যে খালগুলো একসময় মানুষের জীবনযাত্রা ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল, সেগুলোর ইতিহাসও আজ প্রায় অজানা। খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো) জানে না যশোরের খালধার রোডের পাশে একসময় খাল ছিল, যা দিয়ে নৌকায় করে পণ্য পরিবহন করা হতো। এসব খাল হারানোর পেছনে সরকারি উদাসীনতা এবং স্থানীয়দের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

যশোরে খালধার রোড যে খালের পাড়ে গড়ে উঠেছিল, তা স্বয়ং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এরও অজানা। একসময় এই খাল দিয়ে ভৈরব নদ থেকে নৌকায় করে মালামাল আনা-নেওয়া হতো। মানুষ এই খাল হয়ে আর এন রোড বা রবীন্দ্রনাথ সড়কে উঠত, সেখান থেকে বড় বাজারে যেত। বর্তমানে পশ্চিম বারান্দিপাড়ার বরফকলের পাশ দিয়ে ভৈরব নদ পর্যন্ত বিস্তৃত সেই বিশাল খালটি কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। এখন এর অস্তিত্ব বলতে শুধু একটি মৃত ড্রেন। এভাবেই যশোরের অনেক খাল হারিয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যশোরে কতগুলো খাল খনন বা পুনঃখনন করেছিলেন, তার কোনো নির্দিষ্ট হিসাব পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বা জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। এভাবেই যশোরের খাল সরকারি হিসাব এবং মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার এবং পাউবো-র নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানিয়েছেন, তাদের কাছে জেলার ২০টি নদ-নদীর নাম ও তথ্য থাকলেও খালের বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য নেই।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার বলেন, এই মুহূর্তে তিনি খাল সংক্রান্ত কোনো বিস্তারিত তথ্য দিতে পারছেন না। তথ্য পেতে তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা নেবেন।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, তিনি যশোরের খালগুলোর একটি তালিকা তৈরির চেষ্টা করছেন, যদিও তার মতে এটি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। তার প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলা ব্যতীত জেলার অন্য ৬টি উপজেলায় ৬৩টি খাল রয়েছে, যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৯২ দশমিক ৪২৭ কিলোমিটার।

খালের বিষয়ে বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, তার কর্মরত উপজেলায় মোট ৪১টি খাল রয়েছে, যার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৪১ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার। এখানকার বেশিরভাগ খালই ছোট, তবে সবচেয়ে বড় খাল দুটি হলো রাখালগাছি ও তীরমুনি, যাদের প্রত্যেকের দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটার।

অভয়নগর উপজেলার নির্বাহী অফিসার পার্থ প্রতীম শীল তার উপজেলার খালের কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

এক তথ্যে জানা গেছে, জেলার সব চেয়ে বড় খালগুলি হলো ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কেশবপুরের নুরুনিয়া খাল, একই দৈর্ঘ্যর মণিরামপুরের ঝিকরা খাল এবং জিয়ালদার খাল। এছাড়া রয়েছে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে শার্শার মৌতাখাল, সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কেশবপুরের বিল খুকশিয়া খাল, একই উপজেলার ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে লস্কর খাল, মণিরামপুরে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের গাবুখালী খাল। জেলায় অনেক খালের দৈর্ঘ্য ২০০ মিটারেরও কম রয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সারা দেশে ফসল উৎপাদনের বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে খাল খনন ও পুনঃখনন কর্মসূচি হাতে নেন। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে যশোর জেলাতেও ব্যাপক সাড়া পড়ে এবং অনেক খাল খনন ও সংস্কার করা হয়। তবে, বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা জেলা প্রশাসনের কাছে এই সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম জানান, শহিদ জিয়াউর রহমান শার্শার উলাশি খাল খনন করেছিলেন। কিন্তু এই সংক্রান্ত কোনো নথি বা ফাইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র অনুযায়ী, গত বছর মণিরামপুর ও কেশবপুরের কয়েকটি খালের অংশবিশেষ খনন বা পুনঃখনন করে ভবদহ এলাকার পানি নিষ্কাশনের কাজ করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ক্লাইমেট স্মার্ট প্রজেক্টের আওতায় ঝিকরগাছা উপজেলার ৪টি খালের সাড়ে ১১ কিলোমিটার পুনঃখনন চলছে।

এছাড়াও, আগামী শুষ্ক মৌসুমে অভয়নগর, কেশবপুর, মণিরামপুর এবং ঝিকরগাছা এই চারটি উপজেলার ৩৬টি গুরুত্বপূর্ণ খালের মোট ১১০ কিলোমিটার পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলি খাল সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছর ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েকটি খাল খনন ও পুনঃখনন করানো হয়েছিল।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, স্থানীয় জনগণের অসচেতনতা খালগুলো হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। নদী ও খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ এখানকার একটি সাধারণ সমস্যা। অনেক খাল শুকনো মৌসুমে পানিশূন্য থাকে, আবার কিছু খাল সংস্কারের অভাবে প্রায় মৃত। যদিও বর্ষাকালে খালগুলো কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়, তবে মানুষের সচেতনতা ও স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণ ছাড়া খাল বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাল সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছর ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে কয়েকটি খাল খনন ও পুনঃখনন করা হয়েছিল।

নির্বাহী প্রকৌশলী আরও জানান, শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক খননকৃত উলাশি খালটির বিষয়ে তিনি বিস্তারিত খোঁজ নেবেন এবং এর সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা পাঠাবেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এই খাল সম্পর্কিত কোনো নথি বা ফাইল এখন পর্যন্ত তিনি পাননি। সাধারণত কোনো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার ১০, ১৫ বা ২০ বছর পর সেগুলোর ফাইল ধ্বংস করে ফেলা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এক্ষেত্রেও তেমন কিছুই ঘটে থাকতে পারে।

সারাবাংলা/এসআর

অস্তিত্বহীন খাল খাল খনন পাউবো পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর যশোরের খাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর