ঢাকা: মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। মিরপুর ১০ নম্বরের বাসিন্দা। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় প্রথমবারের মতো তিনি ‘না’ ভোট দিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে তার ওই কেন্দ্রে ২৪টি ‘না’ ভোট পড়েছিল। কিন্তু এর পর আর সেই সুযোগ আসেনি। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে ফের ব্যালটে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত হবে এমনটাই প্রত্যাশা তার। তার মতো অনেকেই চায়, নতুন বাংলাদেশে সংস্কারের মাধ্যমে অপশনটি ফিরে আসুক।
এদিকে, নির্বাচন কমিশনও চাইছে ব্যালটে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করতে। তবে তা ৩০০ আসনের জন্য নয়, শুধুমাত্র একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে বিধানটি ফিরিয়ে আনতে চাই ইসি। কিন্তু এটাকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন না তরুণ প্রজন্ম। কারণ, বর্তমান ইসি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনলে তা তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে। তাই তাদের দাবি ও প্রত্যাশা- ৩০০ আসনের ব্যালটে ফিরবে ‘না’ ভোটের অপশন।
নতুন ‘না’ ভোটের বিধানে যা আছে
নির্বাচন কমিশন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর জয় ঠেকাতে ‘না’ ভোটের বিধান ফিরিয়ে এনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। গত ১১ আগস্ট নির্বাচন ভবনে কমিশন সভা শেষে এ তথ্য জানান নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
ইসি বলেন, “বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ করতেই এই উদ্যোগ। এক্ষেত্রে একজন প্রার্থী থাকলে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে ‘না’ ভোটের সঙ্গে। এক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী বেশি ভোট পেলেই কেবল নির্বাচিত হবেন। বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেলে প্রস্তাব আকারে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এর পর সরকারের সায় পেলে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে।”
কেন ৩০০ আসনে ‘না’ ভোটের বিধান থাকছে না
‘না’ ভোটের বিধান নিয়ে কথা সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ-এর। তিনি বলেন, “আমরা নির্বাচনে ‘না’ ভোট যুক্ত করেছি শুধুমাত্র একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে।” এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্য দিয়ে দেড়শর বেশি আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থীরা বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হন। আসন্ন নির্বাচনে যেন সেই ঘটনার পুনারাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য আমরা একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের অপশন যুক্ত করেছি। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।”
২০০৮ সালে সব আসনে ‘না’ ভোটের অপশন ছিল, এখন কেন নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের দায়িত্ব নির্বাচন করা। ‘না’ ভোটে দিয়ে খুব একটা সুবিধা হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানসহ এই উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশে এই বিধানটি নেই। তাই আমরা ৩০০ আসনে এই বিধান যুক্ত করিনি। যদিও ২০০৮ সালে বিধানটি যুক্ত করা হয়েছিল; কিন্তু সেটাও পরবর্তী সময়ে টেকেনি। আমরা মনে করেছি, যেহেতু উপমহাদেশের কোথাও নেই, তাই আমরা যুক্ত করিনি। যদি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হয় তবে বিধানটি ফিরতে পারে। তবে এই মুহূর্তে বিধানটি রাখা সঠিক মনে করছি না।”
কেমন ছিল ২০০৮ সালের ‘না’ ভোট
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভোটাররা প্রথমবারের মতো ‘না’ ভোট দেন। ওই সময় জারি করা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ধারা ৩১(৫) (বিবি)-তে ‘না’ ভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিধান অনুযায়ী, ব্যালট পেপারের সবশেষ প্রার্থীর স্থানে লেখা ছিল ‘ওপরের কাউকে নয়’ এবং ভোটারদের সহজ পরিচিতির জন্য মার্কা রাখা হয়েছিল ‘ক্রস’ (ঢ)। কোনো আসনে ‘না’ ভোটের সংখ্যা বাক্সে পড়া মোট ভোটের অর্ধেক বা তার বেশি হলে নতুন করে ভোট আয়োজনেরও বিধান ছিল। ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেশি সংখ্যক ভোটারকে কেন্দ্র আনার জন্য এ পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে মনে করা হয়।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে প্রদত্ত মোট ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ ভোটের মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৩৭টি ‘না’ ভোট পড়েছিল। সবচেয়ে বেশি ৩২ হাজার ৬৪টি ‘না’ ভোট পড়েছিল পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনে। তবে কোনো আসনেই পুনর্নির্বাচন হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ‘না’ ভোট পড়েনি। তবে সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ পরে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে ‘না’ ভোটের বিধান বাদ দেয়।
যা বলছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালের পর যদি ‘না’ ভোটের বিধান বাতিল করা না হতো, তাহলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে এত বিশাল সংখ্যক আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী পারতেন না। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম সারাবাংলাকে বলেন, “ইসি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বেশিরভাগ মানা হয়েছে, যা বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে ৩০০ আসনে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ দেওয়া হলেও নির্বাচনে কমিশন সেটি আমলে নেয়নি।”
তিনি বলেন, “এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেশিরভাগ অংশ তরুণ ভোটার। যারা এবার প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন। নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধানটি যুক্ত করলে তরুণ ভোটারদের নির্বাচনে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা সম্ভব হতো।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী সারাবাংলাকে বলেন, “৩০০ আসনে নয়, একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এটি আসলে যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, বিনাভোটে এমপি হওয়া ঠেকাতে গিয়ে ‘না’ ভোটের যে নিয়ম ইসি করছে, ‘ডামি’ প্রার্থী বসিয়ে সেই কৌশল ঠেকিয়ে দিতে পারেন সেই একক প্রার্থী।”
তিনি বলেন, “ধরুন কোনো প্রার্থী যদি দেখেন তার আসনে তিনি একাই প্রার্থী, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন তাকে ‘না’ ভোটের সঙ্গে লড়তে হবে। এজন্য তিনি একজন ডামি প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত হতে পারে।”
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ‘না’ ভোট বাতিল করা নিয়ে সেসময় ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। বিধানটি ফিরিয়ে আনতে আদালতে রিট হয় তখন। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করে সেসময়। সেইসঙ্গে ছিল তরুণ প্রজন্মের তুমুল আগ্রহ ও সমর্থন। এমনকি ২০১৫ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের জন্য মাঠ কর্মকর্তাদের মতামতেও ‘না’ ভোট চালুর প্রস্তাব এসেছিল।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বিষয়টি আর ফিরে আসেনি। যদিও ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ‘না’ ভোট ফিরল, কিন্তু সেখানেও শর্ত। শর্তসাপেক্ষে শুধু একক প্রার্থীর আসনে ‘না’ ভোটের সঙ্গে লড়তে হবে। ইসির এই সিদ্ধান্তে অনেকটাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ তরুণ প্রজন্ম। তাদের দাবি ও প্রত্যাশা- বর্তমান সরকার এই বিধান পরিবর্তন করবে এবং ৩০০ আসনের ব্যালটে ফিরিয়ে আনবে ‘না’ ভোটের বিধান।