যারা বিদেশি আইনজীবী চায় তারা দেশদ্রোহী : অ্যাটর্নি জেনারেল
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১১:১৬
স্টাফ করেনপন্ডেন্ট
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ শুনানির জন্য যারা বিদেশি আইনজীবী চেয়ে বার কাউন্সিলে আবেদন করেছে তাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন শেষে নিজ কার্যালয়ে রোববার বেলা ১১টায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা দেশদ্রোহী। দেশের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা থাকলে তারা এ আবেদন করতে পারতেন না। আমাদের ৫০ হাজার আইনজীবী রয়েছে তারা কি এ শুনানির অযোগ্য প্রশ্ন রাখেন মাহবুবে আলম।
‘রাষ্ট্রের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি এই আস্থাহীনতা খুবই নিন্দনীয়’ বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় বাতিল চেয়ে রিভিউ আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৯৪ গ্রাউন্ড (বিষয়) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর পরপরই সংবাদ সম্মেলন করেন মাহবুবে আলম।
বার কাউন্সিলে বিদেশি আইনজীবী চেয়ে আবেদনকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এর আগে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম সংশোধনী বিষয়ে শুনানি হয়েছে। তখন তো বিদেশি আইনজীবীর দরকার পড়েনি। কোনো দেশের সাংবিধানিক বিষয়ে বিদেশি আইনজীবী শুনানি করেছেন এরকম নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই।’
‘আরেকটা জিনিস আমরা বলতে চেয়েছি, সেটা হলো বিচার বিভাগের স্বধীনতা খর্ব হবে কি হবে না, তা নির্ভর করবে ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে যখন আইন প্রণয়ন করা হবে। সে আইনে কি বিধি-বিধান থাকবে, তদন্তকাজ কে করবেন, তদন্তকাজের পরে রিকমেন্ডেশানটা কি ফর্মে হবে ইত্যাদি সমস্ত বিষয়গুলো যখন উঠে আসবে আইন প্রণয়নের পরে তখনই বোঝা যাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হবে কি হবে না। যেখানে আইনই এখনও তৈরি হয়নি ৯৬(৩) এর অধীনে তখন আগে থেকে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।’
আপনারা কি চেয়েছেন রিভিউতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৩ জুলাই আপিলের খারিজাদেশ পুনর্বিবেচনা করা হোক এবং আমাদের আপিলের রায়টা বাতিল করে রিভিউ পিটিশনটা এলাও করা হোক।
‘পার্লামেন্টের ক্ষমতা রিস্টোর করার জন্য কি আবেদন করেছেন?’
‘না, পার্লামেন্টের জন্য না। পার্লামেন্ট যে সংশোধন করেছিল অর্থাৎ জিয়াউর রহমানের আমলে মার্শাল ল ফরমান দ্বারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নামে সংবিধানে সন্নিবেশন করা হয়েছিল সেটাকে বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল যে অনুচ্ছেদ তাতে আমরা ফিরে যেতে চেয়েছি।’
‘এটা কি বলা যাবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত করে যে ষোড়শ সংশোধনী এনছিল এটা আপনারা পুনর্বহাল চেয়েছেন রিভিউ আবেদনে?’
সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এখানে অনেকের ধারণা সংসদই তাদের অপসারণ করবে। বিষয়টা তা না। যেকোনো বিচারপতি তিনি যদি অসামর্থ্য হন বা তার বিরুদ্ধে যদি অসদাচরণের কোনো অভিযোগ ওঠে সেই ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে কিভাবে তদন্ত হবে সেটা উল্লেখিত হবে ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। সেই তদন্ত হওয়ার পর তদন্ত কমিটি যদি মনে করে যে, তিনি দোষী সেই ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি রিকমেন্ডেশন করবে তার অপসাণের জন্য। সেই রিকমেন্ডেশনটি পার্লামেন্টে যাবে এবং দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সমর্থিত হলেই তখন সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে চূড়ান্ত আদেশের জন্য। কাজেই তদন্ত কমিটি কোনো বিচারপতিকে দোষী সাব্যস্ত না করেন সেক্ষেত্রে কিন্তু এটা পার্লামেন্টে যাবেই না। কাজেই মুখ্য বিষয় হলো একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উত্থাপিত হবে তখন সেটার তদন্ত করার দায়িত্ব কার কাছে থাকবে এবং তদন্তের পদ্ধতিটা কি হবে , তদন্ত কারা কারা করবেন সেটিই হবে মূল বিষয়। এখানে যে পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করা না হয় সে তাকে করার কিছুই নাই।’
দ্রুত শুনানির জন্য কি উদ্যোগ নেবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,অবস্থা বুঝে আমরা ব্যবস্থা করব।
‘সাবেক প্রধান বিচারপতি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন এগুলো কি আপনারা আপনাদের রিভিউ আবেদনে এক্সপাঞ্জ চেয়েছেন?’
‘অবশ্যই, তার (সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা) পর্যবেক্ষণগুলো সুনির্দিষ্ট করে আমরা গ্রাউন্ড নিয়েছি।’
সুপ্রিম কোর্ট ৩৯টি কোড অব কন্ডাক্ট নির্ধারণ করে দিয়েছিল?
কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে আমরা বলেছি, কোড অব কন্ডাক্ট করার কথা হলো যারা নাকি তদন্ত করবেন এবং ৯৬(৩) অধীনে তারা কোড অব কন্ডাক্ট করবেন। কোড অব কন্ডাক্ট তো রায় দিয়ে করার কথা না। কোড অব কন্ডাক্ট এপ্রোভ করার কথা রাষ্ট্রপতির। এখানে (রায়ে) তারা যে কোড অব কন্ডাক্ট করেছেন, আমরা বলেছি এটা কোনো ইস্যুই ছিল না তাদের। এটা অনর্থক।
‘আপিল বিভাগে এখন পাঁচজন বিচারপতি আছেন, রিভিউ শুনানির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা?’
আমি এই সাবকন্টিনেন্টে যতগুলো মামলা দেখেছি, বিশেষ করে ভারতে যে সাংবিধানিক মামলাগুলো হয়েছে, যে মামলাগুলো পাঁচজন বিচারপতি বা সাতজন বিচারপতি করেছেন সেগুলোর যদি উল্টানোর প্রয়োজন হয় বা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার সমান সংখ্যক বা বেশি সংখ্যক বিচারপতিই করেছেন। তবে আমাদের আপিল বিভাগের রুলসে আছে ‘এসপার এস পসিবল’, যতখানি সম্ভব হয়।
‘আপিলে সর্বস্মতিক্রমে সিদ্ধান্তটি হয়েছিল, সেক্ষেত্রে আপনি কতটুকু আশাবাদী’
আশাবাদী বলেই তো গত দুই মাস পরিশ্রম করে আমরা রিভিউ পিটিশনটা তৈরি করেছি।
গ্রাউন্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, অামরা বলেছি, আমরা বলেছি, পার্লামেন্ট মেম্বারদের সম্পর্কে যেসব উক্তি করা হয়েছে, পার্লামেন্ট সম্পর্কে যেসব উক্তি করা হয়েছে, পার্লামেন্ট অপরিপক্ক, পার্লামেন্ট সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না বা সংসদ সদস্যরা ব্যবসায়ী, তারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত আছেন এবং নারী সাংসদরা যেহেতু নির্বাচিত না, সেহেতু বিচারপতিদের অপসারণের ব্যপারে তাদের অংশহগ্রহণ করা সঠিক না, এরকম অনেকগুলো পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য এগুলো আমরা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে বাতিল চেয়েছি।
এত সুনির্দিষ্ট করেছি বলেই গ্রাউন্ডগুলো এত বড় হয়েছে। এজন্যই আমাদের এতদিন পরিশ্রম করতে হয়েছে।
‘কবে নাগাদ শুনানি হতে পারে?’
‘এটা তো নির্ভর করবে আদালতের উপর।’
‘সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড যেটা আমি বলতে চাই, যেটা আমার মাথায় এসেছে সেটা হলো, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে ছিল, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রধান বিচারপতি এবং তার নিচে দুজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়ে কাউন্সিল গঠিত হবে। তারা এই জিনিসগুলোর শুনানি করবেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকেও সুযোগ দেওয়া হবে আত্মপক্ষ সমর্থনের। আমাদের সংবিধানে ৯৬ (৩) এ যেটা আছে, সেটা হলো এ বিষয়ে সরকার আইন প্রণয়ন করবেন। অর্থাৎ সংসদের দুই তৃতিয়াংশের রেজুলেশন না হলে কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করা যাবে না।’
আরেকটি বিষয় হলো ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান হয়, ৯৬(২), (৩) বহাল ছিল ১৯৭৫ এ অবৈধ সামরিক সরকার আসার আগ পর্যন্ত। এই সময়টায় কোনো প্রতিষ্ঠান, কোনো দল এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এই ৯৬(২), (৩) তে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে গেছে, এমন থা তো কেউ বলেনি? কাজেই আজকে যখন আমরা মার্শাল ল দ্বারা প্রণীত একটি বিধানকে অপসারণ করে সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করতে চাই তখন এটাকে কেন আদালত এটাকে অবৈধ ঘোষণা করবে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ শুনানিতে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি চেয়ে বার কাউন্সিলে গত ১৮ ডিসেম্বর আবেদন করে বাদীপক্ষ। আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া ডাকযোগে বার কাউন্সিল চেয়ারম্যান বরাবর এ আবেদন করেন।
এতে বলা হয়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানিতে ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হোক। আবেদনে ভারতীয় তিন আইনজীবীর নামও সুপারিশ করা হয়।
ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের তিন আইনজীবী হলেন, অ্যাডভোকেট আগারওয়াল আমবুজ, অ্যাডভোকেট আগারওয়াল অনামিকা গুপ্তা ও অধিমোলাম ভেংকটারমন।
চিঠি পাওয়ার দশদিনের মধ্যেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে বার কাউন্সিলকে অনুরোধও করেছেন আবেদনকারী।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি গত ১ আগস্ট প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
এরপর গত ১০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এরপর ১৮ আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়গুলোর একটি বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রাখা হয়েছিল।
এরপর ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এরপর ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ।
সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ই নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী।
প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেন।
রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।
পরে ২০১৬ সালের ৫ই মে হাই কোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেযন।
এর বিরুদ্ধেই আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ, যা এ বছরের ৩ জুলাই খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
সারাবাংলা/একে