সুনামগঞ্জ: বর্ষার জলভরা হাওর—যেন অসীম বিস্তৃত নীলাভ সমুদ্র। এমন দৃশ্যপটে সুনামগঞ্জের মানুষের জীবনের সঙ্গে নৌকার সম্পর্ক অনিবার্য। বছরের ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে হাওরপাড়ের গ্রাম, খেতখামার আর আঙিনা। তখন হেঁটে নয়, একমাত্র বাহন নৌকাই ভরসা ।
এই প্রয়োজনকে ঘিরেই সদর উপজেলার কুরবান নগর ইউনিয়নের মাইজবাড়ি গ্রাম পেয়েছে বিশেষ পরিচিতি—‘নৌকার গ্রাম’। কয়েক যুগ ধরে এখানে তৈরি হচ্ছে কাঠের নৌকা। এখন গ্রামের প্রায় ৩ হাজার মানুষের একমাত্র পেশা নৌকা বানানো। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাতুড়ির ঠকঠক শব্দে মুখর থাকে গোটা গ্রাম। সেই শব্দ শুধু কাঠে পেরেক ঠোকার নয়; বরং হাওরবাসীর টিকে থাকার গল্পও বলে।
প্রতিবছর এখান থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার নৌকা বিক্রি হয়। শুধু সুনামগঞ্জেই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ ব্যবহার করেন এই নৌকা। চলাচলের পাশাপাশি মাছ ধরা, পাথর তোলা কিংবা বালুর ঘাটে কাজ করতেও ভরসা রাখা হয় এই বাহনে। তাই বর্ষাকাল মানেই মাইজবাড়ির নৌকা বেচাকেনার মৌসুম।
তবে এই গ্রাম শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি হাওরের সংস্কৃতিরও প্রতিচ্ছবি। সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের মানুষ যে হাওরনির্ভর—চিন্তা, জীবনযাপন, উৎসব-অনুষ্ঠান সবকিছুতে—মাইজবাড়ির নৌকা শিল্প তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
গ্রামের প্রবীণরা বলেন, ভোরের আলো ফুটতেই কারিগররা কাজে লেগে যান। কাঠ কেটে পালিশ করা, আকারে আনা, তারপর পালা করে বাঁধাই—এই পুরো প্রক্রিয়াতেই লেগে থাকে কয়েকজন দক্ষ কারিগর। পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নৌকা বানানোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
কিন্তু বছরের পর বছর পরিশ্রম করেও খুব একটা বদল আসেনি কারিগরদের জীবনে। অনেকেই বলেন, এ শিল্প থেকে টিকে থাকা গেলেও ভাগ্য বদল হচ্ছে না। বাজারের ওঠানামা, কাঠের দামের অস্থিরতা, আর আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থার বিস্তার তাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুনামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা জেরিন বলেন, নৌকা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ দরকার। তার ভাষায়, ‘এই শিল্প যদি আমরা সুরক্ষিত করতে পারি, তাহলে শুধু একটি গ্রাম নয়, পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবন বদলে যাবে।’