ঢাকা: গ্রামে লেখাপড়া করতেন মারুফ হোসেন। তাকে নিয়ে ফুচকাওয়ালা বাবার স্বপ্ন ছিল আকাশসম। আর ছেলেও ছুটি পেলে বাবার কাজে সহায়তায় ছুটে আসতেন ঢাকায়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে তাকে বাঁচতে দিল না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিজিবির গুলিতে শহিদ হন সংসারের এই বড় ছেলে। গুলিবিদ্ধ মারুফকে হাসপাতালেও নিতে দেয়নি পুলিশ-বিজিবি। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুলির ক্ষত স্থানটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখেন এক পুলিশ সদস্য।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিতে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব বিবরণ দেন শহিদ মারুফের বাবা মো. ইদ্রিস। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সোমবার (২৫ আগস্ট) ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অষ্টম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ। আর এ মামলায় ২২ নম্বর সাক্ষী হিসেবে ইদ্রিসের জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল।
জবানবন্দিতে ৪৪ বছর বয়সী ইদ্রিস বলেন, ‘মারুফ আমার বড় ছেলে ছিল। বরিশালে কাজিরহাট একতা ডিগ্রি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তো। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছুটি পেলে ঢাকায় এসে আমাকে সাহায্য করতো। তাকে শিক্ষিত বানানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তা আর হলে না।’
সাক্ষী বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় অংশ নেয় আমার ছেলে। ১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টায় সে বাসা থেকে রের হয়। সঙ্গে তার মামা ফয়সাল আহমেদ ছিলেন। জুমার নামাজের পর তারা দুজন বাসায় এসে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে সাড়ে তিনটার দিকে আন্দোলনের জন্য বের হয়ে যায় মারুফ। পরে ফোন করে তার মামাকে ডেকে নেয়। একটু পর তার মামা ফয়সাল আমাকে ফোন দিয়ে জানান- ‘রামপুরা ব্রিজ থেকে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছুড়ছে’।’
ওই দিন পৌনে ৬টার দিকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মারুফ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে ইদ্রিসকে ফোনে জানান ফয়সাল। গুলিবিদ্ধের পর প্রথমে তাকে এ এম জেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। অ্যাম্বুলেন্সে ঢামেকে নেওয়ার পথেই বাধা হয়ে দাঁড়ান গুলি বর্ষণকারীরা।
সে বর্ণনা দিয়ে ইদ্রিস বলেন, ‘‘এ এম জেড হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে মারুফকে ঢামেকে নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু রামপুরা ব্রিজে পৌঁছালে ১৫-২০ মিনিট ধরে অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রাখে পুলিশ-বিজিবি। তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও ছিলেন। এ সময় এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন- ‘সে মারা গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই। বাড়ি নিয়ে যান’।’’
তখনও জীবিত ছিলেন মারুফ। তার গুলিবিদ্ধ ক্ষতটি গামছায় মোড়ানো ছিল। আর মুখে ছিল অক্সিজেন মাস্ক। ঠিক তখনই পুলিশের একজন নিজের কাছে থাকা রাইফেলের বাঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারুফের শরীরে গুলিবিদ্ধ স্থানটি দেখেন। এতে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন মারুফ। এরপর তাদের অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দেওয়া হয়।
মারুফের বাবা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দেওয়ার পর মারুফকে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় আমি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাই। ৭টা ২০ মিনিটে আমার ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। পরে ছেলের লাশ নিতে চাইলে ময়নাতদন্ত ছাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ময়নাতদন্ত শেষে ২১ জুলাই লাশটি হস্তান্তর করেন তারা। এরপর জানাজা শেষে পূর্ব বাড্ডা কবরস্থানে আমার ছেলেকে দাফন করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশি বাধার কারণে আমার ছেলের ময়নাতদন্ত দেরি হয়েছে। কেননা বাড্ডা থানার তৎকালীন ওসি আমার ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি নিজ থানা এলাকায় ঘটেছে বলে অস্বীকার করেছিলেন। আমি তার হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’
এ সময় ছেলে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করেন। আর সরাসরি জড়িত থাকায় সাবেক এমপি ওয়াকিল উদ্দিন, স্থানীয় কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর, কাউন্সিলর তাপস, রামপুরা থানার ওসিসহ গুলি বর্ষণকারী বিজিবির রেদওয়ানের বিচার চান শহিদ মারুফের বাবা ইদ্রিস।