ঢাকা: রাজধানীর খুচরা কাঁচাবাজারগুলোতে হঠাৎ করেই সবজির দামে আগুন। কৃষকরা প্রকৃত মূল্য না পেলেও বাজারে সবধরনেরই সবজি বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। সুপার মার্কেট, সাধারণ বাজার, এমনকি ভ্যানগাড়িতেও ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজি। গতবছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের পর সবজির বাজারে স্বস্তি মিললেও এখন সেটি রূপ নিয়েছে আগুন দামে। ফলে নাভিশ্বাস পোহাতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের। আর এর পেছনে ফের চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন সাধরণ মানুষ।
জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে গতবছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী সরকারের। এর পর পথে পথে চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম কমে বাজারগুলোতে হু হু করে কমতে থাকে সবজির দাম। ফলে সবধরণের সবজি নেমে আসে ৩০টাকা কেজির ভেতরে, যা সরকার পরিবর্তনের আগেরদিনও বিক্রি হয়েছে প্রায় ৮০টাকা কেজি দরে। কিন্তু কয়েকমাস পর থেকেই ধীরে ধীরে ফের বাড়তে থাকে সবজির দাম, যা এখন পার করে দিয়েছে ১০০ এর কোটা। তবে কি সরকার পরিবর্তনের আগের সেই চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেট ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে?— এমনটাই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
সরেজমিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, মহাখালী ও মগবাজার এলাকার খুচরা বাজারঘুরে দেখা যায়, বাজারে পর্যাপ্ত সবজির জোগান রয়েছে। কিন্তু দাম হাতের নাগালের বাইরে। শিম, বেগুন, মুলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, বরবটি, কাকরোল, করলা-উস্তা, ঢেঁড়শসহ অন্যান্য সব সবজি ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে মিলছে না। শুধু পেঁপে ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। আর শশা ও টমেটো বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২০০টাকা কেজি। আড়ৎ থেকে বেশি দামে সবজি কিনে আনায় খুচরা বিক্রেতাদেরও বেশি দামে তা বিক্রি করতে হচ্ছে।
খুচরা বাজারের সঙ্গে পাইকারি বাজারের দামে বেশ পার্থক্য দেখা গেছে। সবজির পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, কাকরোল ও করলার পাল্লা (৫ কেজি) ১৪০ থেকে ২০০ টাকার ভেতরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু খুচরা বাজারে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি দাম। বেগুনের পাল্লা (৫ কেজি) পাইকারি ২৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি করা হলেও খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি। এভাবেই খুচরা ও পাইকারি বাজারের সঙ্গে দামে পার্থক্য তৈরি করা হয়েছে। আর এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে। মিটফোর্ডসহ কয়েকটি ভাইরাল ঘটনায় চাঁদা ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, অধিক মুনাফার জন্য এরকম কাজ কেন করব। আগের সরকারের সময়ে পথে পথে চাঁদা ও হাত বদলের কারণে সবজির দাম বেড়ে যেত। সরকার পরিবর্তনের পর কোথাও তখন চাঁদা দিতে হতো না এবং সিন্ডিকেট যারা করত তারাও সেটা থেকে বিরত ছিল, তাই দাম কমেছিল। কিন্তু বর্তমানে বোঝা যাচ্ছে, শুধু হাত বদল হয়েছে। সবকিছু এখন আগের মতোই চলছে। পথে ও বাজার মিলে কয়েক ধাপে চাঁদা দিতে হচ্ছে।
এদিকে পট পরিবর্তনের পর দেশে কমানো হয় সবধরনের জ্বালানি তেলের দাম। ডিজেলের দাম দুই টাকা কমিয়ে ১০২ টাকা, অকটেনের দাম তিন টাকা কমিয়ে ১২২ টাকা ও পেট্রলের দাম তিন টাকা কমিয়ে ১১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তার পরও পরিবহণ সেক্টরে বাড়তি খরচ হওয়ারও দাবি করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে।
মহাখালীর কাঁচাবাজার থেকে সবজি কিনছিলেন সালমা বেগম। দামের বিষয়ে জানতে চাইলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘অনেক দাম, তাই বেশি কিছু কিনছি না। পেঁপে আর কচুর ছড়ার দাম একটু কম আছে। বাসায় সবাই সবজি বেশি খায়। কিন্তু দাম বেশি হওয়ার কারণে অল্প করেই কিনতে হচ্ছে।’
রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বরে বসবাস করেন ক্রেতা আরিফুল ইসলাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাজারে প্রতিনিয়ত দাম বেড়েই যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পর দাম কমই ছিল। কিন্তু হঠাৎ সেই আওয়ামী সরকারের সময়ের মতো বাড়তি দাম। তিন কেজির জায়গায় এক কেজি সবজি কিনছি। সাধারণ মানুষ জিম্মি, কিছু করার নাই।’ তিনিসহ অন্যান্য ক্রেতারা বাজার মনিটরিংয়ে দুর্বলতা এবং সরকারের নির্ধারিত তদারকি কার্যক্রম কার্যকর না বিষয়েও অভিযোগ তোলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবহণ ব্যয় কিংবা সরবরাহ ঘাটতির অজুহাত সবসময় থাকে। কিন্তু বাস্তবে এর পেছনে সক্রিয় থাকে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা একযোগে দাম নিয়ন্ত্রণ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। ফলে কৃষকের মাঠ থেকে কম দামে কেনা সবজি ভোক্তার কাছে পৌঁছায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সরকারের কঠোর বাজার মনিটরিং এবং উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সরবরাহ শৃঙ্খলা স্বচ্ছ করা জরুরি।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট সব বন্ধ ছিল। যারা এসব করত, তারা তখন একটা ভয়ের মধ্যে ছিল। কিন্তু পরে দেখল, যে লাউ সেই কদু। যারা আগে এ ধরনের অপরাধ করত, তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং আগের মতো অপকর্ম শুরু করেছে। আর সরকারের আগে বাজার মনিটরিং ছিল। এখন সেটা ঢিলেঢালা যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা এখন কোনো তোয়াক্কাই করছে না, যে যার মতো দাম নির্ধারণ করছে।’
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের করণীয় কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে যা বলছি, সেগুলো শুনছে না। বাজার তদারকি করা দরকার, সেটাও করা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এটা করলে বাজার হয়তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।’
বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কথা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন পরিস্থিতি কেমন সেটা আগে বুঝতে হবে। কিছু জায়গায় অতিবৃষ্টির কারণে উৎপাদন কম হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে সিজনাল সবজি সময় মতো প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। মনিটরিং ও কনস্ট্যান্ড পলিসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক জায়গায় কৃষকরা সারও সঠিক দামে পাচ্ছে না। এসব বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। আর বাজার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি আগেও শক্তিশালী ছিল, এখনও রয়েছে।’
এর আগে, গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেট পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘সবজির দাম কিছুটা বাড়লেও বাজার স্বাভাবিক রয়েছে। প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে শাক-সবজির দাম বেড়েছে। পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে আসতে আসতেই অনেক দাম বেড়ে যাচ্ছে।’ তবে প্রচুর আলু মজুত রয়েছে বলেও জানান তিনি।