Thursday 28 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জল আর সবুজে জেগে থাকে জলাবন রাতারগুল

জুলফিকার তাজুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৮ আগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৯ | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৫ ১০:১১

সিলেটের জলাবন রাতারগুল। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট: রাতারগুল— বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন, যেখানে বর্ষায় গাছ ডুবে থাকে জলে, আর প্রকৃতি হয়ে ওঠে এক জাদুকরী ছবি। কিন্তু সৌন্দর্যের আড়ালেও থাকে নিঃশব্দ হুমকি। বালুখেকোদের আগ্রাসন ও পর্যটনের চাপ ধ্বংস করছিল রাতারগুলের জীববৈচিত্র্য। আর তখনই বন বাঁচাতে রুখে দাঁড়ায় স্থানীয়রা। নিজেদের বন নিজেরা পাহারা দেয়, সচেতনতা গড়ে তোলে। কারণ, রাতারগুল শুধু বন নয়— এটা তাদের ভবিষ্যতের আশা।

সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি, লালাখাল, শ্রীপুর, রাংপানি, উৎমা ছড়া, লোভাছড়া— এইসব জায়গার সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতিকারীদের কারণে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই অভ্যুত্থানের পর পূণ্যভূমি সিলেটের সবগুলো পর্যটনকেন্দ্রে কালো থাবা বসিয়েছিল দুষ্কৃতিকারীরা। সর্বদলীয় ‘ঐক্যমতে’ ‘প্রশাসনের ছত্রছায়ায়’ হরিলুট চালিয়েছে বালু ও পাথরখেকোরা। বালু-পাথর লুটের কারণে এসব পর্যটনকেন্দ্র যখন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে।

বিজ্ঞাপন

ঠিক তখনই এক আশার নাম হয়ে উঠেছে রাতারগুল। দেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন, যা এখনো রয়ে গেছে প্রায় অবিকৃত, একেবারে প্রাকৃতিক রূপে। আর সেটি রক্ষার কৃতিত্ব! কোনো প্রশাসনিক ঢালের মাধ্যমে নয়, বরং প্রান্তিক গ্রামীণ মানুষের অসম্ভব মমতা আর সংকল্প।

সিলেটের জলাবন রাতারগুল। ছবি: সংগৃহীত

সিলেটের জলাবন রাতারগুল। ছবি: সংগৃহীত

গেল মাসের ঘটনা। রাতারগুলে কয়েকজন বালুখেকো অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু করে। খবর পেয়ে গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের আটক করে বন কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেয়। বালু ছাড়াও বন বাঁচাতে তারা বিষটোপ দিয়ে মাছ শিকার, গাছ কাটা ও পাখি শিকার বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া, শুকনো মৌসুমে আগুন থেকে বন রক্ষা যেন এখন রাতারগুলবাসীদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে রাতারগুলের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার ফল এখন নগদে পাচ্ছেন স্থানীয়রা। জাফলং, বিছনাকান্দি, সাদাপাথরসহ অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যখন পর্যটক বিমুখ তখন রাতারগুলে ভিড় করছেন পর্যটকেরা। সরেজমিনে হাজারো পর্যটককে নৌকা দিয়ে বনের ভেতরে ঘুরতে দেখা গেছে। বছরের পর বছর ধরে রাতারগুল মুগ্ধ করে আসছে প্রকৃতিপ্রেমীদের। কিন্তু যখন পর্যটনের চাপ বেড়ে যাচ্ছে, তখনই স্থানীয় মানুষ নিজেরাই দাঁড়িয়েছেন বন রক্ষার ফ্রন্টলাইনে।

২০১৪ সালে রাতারগুলকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে সরকার। এর পর বন বিভাগের কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। তবে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে উঠেছে ভিন্ন এক মডেল।

রাতারগুলো ঢুকলে মানতে হবে নিয়ম

পর্যটকদের জন্য এখন সুনির্দিষ্ট নৌপথ নির্ধারণের দাবি উঠেছে। বেশি নৌকা যেন না চলে, গাইডরা যেন প্রশিক্ষিত হন— এই চাহিদা রেখেছেন গ্রামবাসীরা নিজেই। তারা গঠন করেছেন বন রক্ষা কমিটি। নিজেরাই পাহারা দেন, কাউকে প্লাস্টিক ফেলতে দেখলে সাবধান করেন, অনুরোধ করেন শব্দ কমাতে।

রাতারগুলের প্রাণ-প্রকৃতির বন্ধু স্থানীয় পরিবেশকর্মী সোনা মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নিজেরাই এখন বন পাহারা দিচ্ছি। যারা প্লাস্টিক ফেলে, শব্দ করে— তাদের নিষেধ করছি, বুঝাচ্ছি। এটা শুধু বন না, এটা আমাদের ভবিষ্যতের আশা।’

সিলেটের জলাবন রাতারগুল। ছবি: সংগৃহীত

সিলেটের জলাবন রাতারগুল। ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় বাসিন্দা নৌকার মাঝি ইমান উদ্দিন সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এই বন আছে বলেই মানুষ আসে। আমরা চাই, বনটা বাঁচুক, আমরাও উপকার পাই। কিন্তু, সেটা নিয়ম মেনে হলে সবারই ভালো।’

রাতারগুলে নেই লোভের ছায়া, নেই দখলের সংঘর্ষ, কিংবা পর্যটন ব্যবসার দৌড়ঝাঁপ। রাতারগুল এক ব্যতিক্রম জায়গা। কারণ, এখানকার মানুষ বনকে ভোগের বস্তু হিসেবে নয়, বরং ভালোবাসার বস্তু হিসেবে দেখে। এখানে ‘ব্যবসা’ নয়, ‘সম্মান’— এই বোধটাই রক্ষা করছে বন।

গ্রামবাসী, বন বিভাগ ও পর্যটকদের মধ্যে সমন্বয় হলে কেবল রাতারগুল নয়, সিলেটের অন্য এলাকাগুলোও রক্ষা করা সম্ভব। এখানকার মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে— চাইলেই পরিবেশ ও পর্যটন একসঙ্গে টিকে থাকতে পারে, যদি থাকে সচেতনতা আর সদিচ্ছা।

সারাবাংলা/পিটিএম

জলাবন রাতারগুল সিলেট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর