ঢাকা: নিয়ম বা আইনে নেই, দেশর কোথাও নেওয়াও হয় না। কিন্তু কর সম্পর্কিত প্রচলতি আইনকে অনেকটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইন্টারনেট ব্যবসায় ১০ শতাংশ পৌর কর আরোপ করতে চায় বগুড়া পৌরসভা। যদিও এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) দু’বার চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিল পৌর কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তারা সেটা আমলে নেয়নি। শুধু তাই নয়, দেশের কোথাও এমন করের নজির না থাকলেও ক্ষমতাচ্যুত ও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২৩ সালে নেওয়া ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসতে এখনও অনঢ় ওই পৌরসভা।
এদিকে বৈষম্যমূলক ওই সিদ্ধান্তে স্থানীয় ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ায় ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হুমকিতে পড়েছেন তারা। এমনকি আয়কর রিটার্ন জমা দিতেও বিড়ম্বনায় রয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সরকারের প্রচলিত সব আইন মেনেই সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরদের ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। আইএসপি ব্যবসায়ীদের বাৎসরিক নবায়ন ফি, লাইসেন্স ফি, ব্যাংক গ্যারিন্টি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এর বাইরে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বার্ষিক আয়ের ওপর আয়কর ও সংযোগ ফি’র ওপর সরকার নির্ধারিত ৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। ব্যবসা পরিচালনা করতে বিটিআরসি কর্তৃক নির্ধারিত আরও নানা শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
তবে একমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে এসব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন করে পৌর করের আবির্ভাব ঘটিয়ে ইন্টারেট প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বগুড়া পৌরসভা। তারা বলছে, সরকারের অন্য আইনে যাই থাকুক, বগুড়ায় ইন্টারনেট ব্যবসা করতে হলে ১০ শতাংশ পৌর কর পরিশোধ করেই করতে হবে! বগুড়া পৌরবিধি অনুযায়ী এই আইনই সেখানে বলবৎ থাকবে!
একমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে বগুড়ায় কেন এই কর? এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলম রিপন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পৌরসভার পৌরবিধি অনুযায়ী এই কর আরোপ করা হয়েছে। এটি কার্যবিধিতে দেওয়া আছে। পৌরসভা চলবে পৌরসভার আইনে। অন্যান্য সংস্থার আইনে কি আছে সেটি ভিন্ন বিষয়, একমাত্র পৌরসভার অথরিটি হচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। যদি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণায়ল থেকে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা আসে তাহলে পৌরসভা সেটি মেনে চলবে।’
সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরিষদ কর্তৃক যে কর আরোপ করা হয়েছে, আমি এককভাবে যদি সেটি বাদ দেই, তখন সেটি ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্যই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। আমি উনাদের বলেছি, বিটিআরসিতে বারবার না গিয়ে আপনারা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে যান। বিটিআরসি যদি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়, তখন মন্ত্রণালয় হয়তো সেটি ব্যবস্থা নিতে পারে।’
জানতে চাইলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হয়তো চলছে। আমি পৌর প্রশাসককে বলেছি। তারা এটি রিভিউ করছে কিনা খোঁজ নিতে হবে। বিষয়টি আমি শুনেছি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের অন্য পৌরসভা যেভাবে চলছে, বগুড়া পৌরসভা সেভাবেই চলবে। পৌরসভার স্বাধীনতা আছে বলেই অন্যদের থেকে ভিন্ন কিছু করবে, তা হবে না। নিশ্চয় অন্যদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কাজ করতে হবে। আমি একবার বলেছি, এখন আবারও বিষয়টির আপডেট নেব।’
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীকে মোবাইল ফোনে একাধিকাবার কল করেও পাওয়া যায়নি।
তবে এ বিষয়ে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের উপ-পরিচালক এস এম গোলাম সরোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবসায় বগুড়া পৌরসভা যে ১০ শতাংশ কর আরোপের কথা বলছে, সেটি থেকে সরে আসতে আমরা এরই মধ্যে দু’বার চিঠি দিয়েছি। আমরা অনুরোধ করেছি, তাদের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে। কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় চিঠি দেওয়ার পরও তারা তা আমলে নেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে আমরা এখন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবো। আমাদের মন্ত্রণালয় হয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে। এই সমস্যার সমাধানে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব।’
যা বলছেন ব্যবসায়ীরা
বিষয়টির সুরাহা করতে স্থানীয় ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা বগুড়া পৌরসভা কর্তৃপক্ষ, ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রীয় সংগঠন আইএসপিএবি ও টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির দ্বারস্থ হয়েছে। তবে সমাধান আসেনি। দীর্ঘদিন ধরে তারা লাইসেন্স নবায়ন করতে পারছেন না। এতে তারা ব্যবসায়িক নানা জটিলতায় পড়ছেন।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পৌর পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বগুড়া পৌর এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ ও মাসিক ফি’র ওপর ১০ শতাংশ বাৎসরিক পৌর কর আরোপ করে। বিটিআরসি থেকে দু’বার চিঠি দেওয়া হয় এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে। প্রথম চিঠির পর চলতি বছরের ২১ জুলাই বিটিআরসি বগুড়া পৌরসভাকে আবারও চিঠি দেয়। গত ২৭ আগস্ট বগুড়া পৌরসভা তাদের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসার অনঢ় অবস্থানের কথা জানিয়ে বিটিআরসিকে চিঠি পাঠিয়েছে।
আইএসপিএবি বগুড়ার সভাপতি শরিফুল আলম মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পৌর করসংক্রান্ত এই জটিলতার কারণে ব্যাংকে আমাদের ঝামেলা হচ্ছে। আয়কর রিটার্ন দেওয়ার সময় নবায়নকৃত ট্রেড লাইসেন্স চাওয়া হয়, ব্যবসার প্রায় সব ক্ষেত্রেই আপডেটেড ট্রেড লাইসেন্স চায়। কিন্তু, আমরা সেটি দিতে পারছি না। এর আগে ব্যাংক থেকে আমাদের অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের লেনদেনও বন্ধ করেছিল। পরে এই অনৈতিক করসংক্রান্ত চলমান প্রক্রিয়ার কাগজপত্র দিয়ে অ্যাকাউন্টগুলো সচল করে নিয়েছিল। সম্প্রতি ব্যাংকগুলো থেকে আবারও নবায়নকৃত ট্রেড লাইসেন্স চাচ্ছে। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে যে রেটে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, এখন বলা হচ্ছে, নবায়নকৃত লাইসেন্স না দিলে সুদের হারও আরও বেড়ে উচ্চ সুদে চলে যাবে।’
বগুড়ার ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ও আইএসপিএবি বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে আমাদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করে দিচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের পৌর মেয়র ও কাউন্সিলররা জবরদস্তিমূলকভাবে আমাদের ওপর ১০ শতাংশ কর বসিয়েছে। কিন্তু, আমরা তো বিটিআরসির নিয়ম কানুন মেনে ব্যবসা করছি। আমাদের যে ৫ শতাংশ ভ্যাট, সরকারকে তা দিয়ে আসছি। পাশাপাশি আমাদের যে আয়কর তাও আমরা দিয়ে দিচ্ছি। আমরা প্রতি মাসে বিটিআরসিকে রিপোর্ট পাঠাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৌর কর্তৃপক্ষ জানায় পৌরসভার নিয়ম অনুযায়ীই আপনাদের এখানে ব্যবসা করতে হবে। এখানকার ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের ওপর এই কর তারা অযৌক্তিকভাবে দাবি করছে। আমরা এই অনৈতিক ও অন্যয্য সিদ্ধান্ত মানতে রাজি নই। সেজন্য তারা আমাদের লাইসেন্স নবায়ন করে দিচ্ছে না। এতে আমরা নানা জটিলতায় পড়ছি। চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দেশের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) মহাসচিব নাজমুল করিম ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘‘ইন্টারনেট হচ্ছে আমাদের মৌলিক অধিকার। বগুড়া পৌরসভা যদি এটি না মানে, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সারাদেশের ইন্টারনেটের জন্য যে ‘এক দেশ, এক রেট’- সেটি তো আর থাকবে না। তখন তো সেখানে ইন্টারনেটের দাম আরও বাড়াতে হবে, যা সরাসরি জনগণের ওপর গিয়ে পড়বে। আমরা মনে করি, বগুড়া পৌরসভার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত। কারণ, দেশের অন্য কোনো পৌরসভায় ইন্টারনেটের ওপর বাড়তি পৌর কর নেই। ইন্টারনেট একটি পণ্য, সারাদেশে একটি রেটেই চলে। বগুড়ার জনগণও একই দামে ইন্টারনেট পাক সেটিই আমাদের চাওয়া।’’