রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের মনোনয়ন বিতরণ শেষ হচ্ছে আগামীকাল। শেষ সময় ঘনিয়ে আসায় নির্বাচনী আবহে সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস। তবে চারবার তফসিল পুনর্বিন্যাস এবং দুবার ভোট গ্রহণের তারিখ পরিবর্তন করায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে চলছে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট।
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকে রাজনীতিতে অনাগ্রহী থাকলেও নির্বাচন ঘিরে আবারও ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে। ফলে ভোটকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ বাড়ছে।
পাঁচ দিনে মনোনয়ন তুলেছেন ৫৯৫ প্রার্থী
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ দিনে মোট ৫৯৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে রাকসুর কেন্দ্রীয় ২৩টি পদে ১৯৯ জন, সিনেটের পাঁচটি পদে ২৬ জন এবং হল সংসদের বিভিন্ন পদের জন্য ৩৭০ জন মনোনয়ন নিয়েছেন। এর আগে চার দিনে মোট ৫৫৮ জন প্রার্থী ফরম নিয়েছিলেন।
প্রথমে ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২৬ আগস্ট ছিল মনোনয়নপত্র বিতরণের শেষ দিন। তবে মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে রাকসুর কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনোনয়ন বিতরণের সময় বাড়িয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, ভোটকেন্দ্র অ্যাকাডেমিক ভবনে আনা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পরিবর্তন এবং ডোপ টেস্ট করতে অতিরিক্ত সময় লাগায় সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করাও এর অন্যতম লক্ষ্য।
বারবার তফসিল পরিবর্তনে সমালোচনা
একই দিনে একাধিকবার তফসিল পরিবর্তন করায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ১৮ ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার তফসিল পুনর্বিন্যাস এবং নয় ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার সময় পরিবর্তন করেছে কমিশন।
প্রথমে ১৭ আগস্ট মনোনয়ন বিতরণ শুরুর কথা থাকলেও আগের রাতে তা স্থগিত করা হয়। পরে নতুন তফসিলে ২৪-২৬ আগস্ট সময় নির্ধারণ করা হয়। এর পর ২৬ আগস্ট জরুরি বৈঠকে সময় বাড়িয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়। এর পরদিন ২৭ আগস্ট দুপুরে কমিশন ঘোষণা দেয় নির্বাচন ২৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে রাতে আবার বৈঠক ডেকে সর্বশেষ ২৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
এ বিষয়ে রাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল বলেন, “সব শিক্ষার্থীর সেন্টিমেন্টকে উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশন তারিখ পরিবর্তন করেছে। এ কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।”
ইতিহাসে প্রথমবার প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট
রাকসুর ইতিহাসে এবারই প্রথম প্রার্থী বাছাইয়ে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রাকসু, সিনেট ও হল সংসদের সব প্রার্থীকেই এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৮৭ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ডোপ টেস্টের খরচ বহন করছে কমিশন আর ফলাফল পজিটিভ হলে প্রার্থিতা বাতিল হবে। রাকসু ও সিনেট নির্বাচনের জন্য দুই দিনে এবং হল সংসদের জন্য চার দিনে এ কার্যক্রম চলবে। এ বিষয়ে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “এক বা দুইদিনের মধ্যে প্রার্থীরা ডোপ টেস্টের প্রতিবেদন পেয়ে যাবেন। সেই প্রতিবেদন নিয়ে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে জমা দিতে হবে।”
রাকসুর ইতিহাসে প্রথম নারী ভিপি প্রার্থী
রাকসুর ৬৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রার্থী হয়েছেন তাসিন খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাসিন শুক্রবার (২৯ আগস্ট) ফেসবুকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি এরইমধ্যে ভিপি পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তাসিন ‘জুলাই আন্দোলন’-এ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বলেন, “রাকসু একটি ঐতিহাসিক সুযোগ, তাই আমার পরিকল্পনা নিয়ে অংশগ্রহণ করছি। তবে নির্বাচনে সাইবার বুলিং ও ব্যক্তিগত আক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।”
নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ছাত্রসংগঠনগুলো
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেমেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এরইমধ্যে রাকসু ও সিনেটের মোট ২৫টি পদে মনোনয়ন তুলেছে। এর মধ্যে রাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য ২৩ এবং সিনেটের জন্য দুইটি। রাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, “রাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা নেতাকর্মীদের মনোনয়ন ফরম উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছি। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় নির্দেশে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করা হবে।”
শাখা ছাত্রশিবিরও নির্বাচনী দৌড়ে সক্রিয়। সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেজ মেহেদী হাসান জানান, রাকসু ও হল সংসদে শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে মোট ২১৭ জন প্রার্থী মনোনয়ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “আসন্ন রাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে শিবিরের ইনক্লুসিভ প্যানেল থাকবে। ইনশাআল্লাহ খুব শিগগিরই আমরা তা অফিসিয়ালি ঘোষণা করব।”
এ ছাড়া, ছয়টি বাম সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটও নির্বাচনি প্রস্তুতিতে মাঠে নেমেছে। জোট থেকে এখন পর্যন্ত ২৮ জন প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, “এখনো আমাদের অনেক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করবে বলে কথা আছে। এজন্য এখন পর্যন্ত আমরা প্যানেল ঘোষণা করতে পারছি না। তবে মনোনয়ন জমাদানের পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্যানেল ঘোষণা করব।”