ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে এরই মধ্যে মনোনয়ন জমা শেষে ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের প্রার্থীরা। একইরকম চিত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (রাকসু) নির্বাচনের জন্য চলছে মনোনয়নপত্র প্রদান ও জমা দেওয়া। ওদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (চকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নির্ধারিত আইন না থাকায় থেমে আছে সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদ নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনি ঝামেলা সমাধানের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। এর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (জকসু) ছাত্রসংসদ নির্বাচন আইন এরই মধ্যে সিন্ডিকেটে পাস হয়েছে। সেটি এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন অপেক্ষায় রয়েছে।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিষ্ঠিত পুর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব নীতিমালা থাকায় সহজেই আয়োজন করতে পারছে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব কোনো নীতিমালা না থাকায় ওই পথে হাঁটতে পারছে না। এর জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন। আর এই অনুমোদন নিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও যাতে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের পথে হাঁটতে পারে সেজন্য চাপ দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
সেই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (জকসু) নির্বাচনে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এর জন্য স্মারকলিপি জমা দিয়ে নেমে পড়েছেন আন্দোলনে। তবে জকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় মতানৈক্য রয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো ছাত্রসংগঠন শর্ত জুড়ে দিয়েছে, কেউ কেউ আবার চাইছে নিঃশর্তভাবে নির্বাচন হোক। তবে সবার চাওয়া জকসু নির্বাচন হতেই হবে।
ছাত্রনেতারা যা বলছেন
জকসু নির্বাচন বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সদস্য সচিব শামসুল আরেফিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জরুরি প্রয়োজন আবাসন। এর সুনির্দিষ্ট একটি রোডম্যাপ আসুক, তার পর জকসু নির্বাচন। আমাদের কাছে শিক্ষার্থীদের সংকটের দাবি আগে। তাদের সংকটকেই আমরা প্রাধান্য দেব বেশি।’ তিনি আরও বলেন ‘আমরা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থী, ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিচার চাই। এর পর হোক জকসু নির্বাচন।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের জেনারেল সেক্রেটারি মো. আব্দুল আলিম আরিফ বলেন, ‘জকসু ও সম্পূরক বৃত্তি আমাদের কাছে দু’টি বিষয়ই সমান ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আবাসন সংকট, টিউশনি না পাওয়া ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই তাৎক্ষণিক স্বস্তির জন্য সম্পূরক বৃত্তি দেওয়া এখন অত্যন্ত জরুরি। আমরা চাই প্রশাসন যাতে জুলাই থেকে হিসাব করে বৃত্তি দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার্থীদের সব সমস্যার সমাধান, ন্যায্য দাবি আদায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি জবাবদিহিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিতে জকসু অপরিহার্য। জকসু না থাকলে সংকট বাড়বে এবং সমাধানের পথ সংকীর্ণ হবে। অতএব, আমরা অবিলম্বে সম্পূরক বৃত্তি ও এর স্থায়ী সমাধানে জকসু চাই।’
জকসু নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, জবি শাখার সভাপতি একেএম রাকিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্পূরক বৃত্তি ও জকসুর কাজ সমান্তরালে চলবে। দু’টোই আমাদের দাবি। দু’টোকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। অক্টোবরের মাঝে আমরা জকসু নির্বাচন চাই। আমাদের দাবি ছিল, জকসুর নীতিমালা ও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ। সেটা এখনো আমরা পাইনি। এখন পর্যন্ত সম্পূরক বৃত্তির নির্দিষ্ট কিছুই প্রশাসন দেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রসংসদ নির্বাচনে সব একসঙ্গে জিততে পারবে না। সবদলের মতই থাকবে। ছাত্ররাজনীতিতে পেশিশক্তির কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। এর জন্যই আমাদের জকসু প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট লাঘবের জন্য সম্পূরক বৃত্তি চেয়েছি।’
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (বাগছাস), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ফয়সাল মুরাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে জকসু নির্বাচন হোক। তবে এর মধ্যেই ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সেইসঙ্গে অবশ্যই সম্পূরক বৃত্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ডেডলাইন ঘোষণা করতে হবে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি ইভান তাহসীন সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘সম্পূরক বৃত্তি ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিচারের শর্ত দিয়ে জকসু নির্বাচন- এমনটা হতে পারে না। যারা এমন কথা বলছেন, সেটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। দু’টোই ভিন্ন বিষয় এবং দুটোই পাশাপাশি চলতে পারে। প্রশাসন চাইলে জকসু নির্বাচন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী মাসের মধ্যে জকসু নির্বাচনের ঘোষণাটা আসা জরুরি।’
জকসু নিয়ে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, জবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান আকাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর অবশেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে জকসু আইন পাস হয়েছে। এখন প্রত্যাশা, ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়ের সব ধাপ দ্রুত অতিক্রম করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই এটি কার্যকর হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্পূরক বৃত্তির কার্যক্রম শুরুর পদক্ষেপ নেওয়া হোক- এটাই এখন আমাদের দাবি। সেইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য জটিলতা ও শিক্ষার্থীদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি মেডিকেল সেন্টার উন্নয়ন ও আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিচার কার্যক্রমও যথাযথভাবে শেষ করতে হবে।’
যা বলছে প্রশাসন
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন জকসু ও সম্পূরক বৃত্তি নিয়ে কাজ করছে। জকসু বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট মিটিং শেষে আমরা এটা ইউজিসিতে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। ওখানে থেকে অনুমোদিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসবে। আমরা আমাদের কাজে কোনো দেরি করছি না। কিন্তু অন্য জায়গার কাজগুলো তো আমাদের অধীনে নয়। এটা শেষ হতে কত সময় লাগবে- এটা তো বলা যাচ্ছে না।’
সম্পূরক বৃত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সম্পূরক বৃত্তি বিষয়ে সরকার সম্মতি দিয়েছে। আমরা ইউজিসি থেকে চিঠি পেয়েছি। আমি ইউজিসির সঙ্গে কথাও বলেছি। চেষ্টা করছি এই বৃত্তির কাজটা কত দ্রুত সম্পন্ন করা যায়।’