ঢাকা: রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার শাসনকে বেসামরিক করার অভিপ্রায়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করেন। রাজধানীর রমনা রেস্তোরাঁয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বিএনপির যাত্রা শুরু হয়। ওইদিন ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন তিনি।
বিএনপিতে বাম, ডান, মধ্যপন্থী— সবধরনের লোক এসে ভিড় জমায়। রাজনীতিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, গবেষক, বিচারপতি, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, লেখক— সবাইকে দলে ভিড়িয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।
প্রথম কমিটিতে স্থান পাওয়া ৭৬ জনের মধ্যে ছিলেন জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মোহাম্মদউল্লাহ, শাহ আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, রসরাজ মন্ডল, আবদুল মোনেম খান, জামাল উদ্দিন আহমেদ, ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মির্জা গোলাম হাফিজ, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক, সাইফুর রহমান, কে এম ওবায়দুর রহমান ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
এছাড়াও শামসুল হুদা চৌধুরী, এনায়েতুল্লাহ্ খান, এসএ বারী এটি, ড. আমিনা রহমান, আবদুর রহমান, ডা. এম এ মতিন, আবদুল আলিম, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নুর মোহাম্মদ খান, আবদুল করিম, শামসুল বারী, মুজিবুর রহমান, ডা. ফরিদুল হুদা, শেখ আলী আশরাফ, আবদুর রহমান বিশ্বাস, ব্যারিস্টার আবদুল হক, ইমরান আলী সরকার, দেওয়ান সিরাজুল হক, এমদাদুর রহমান, অ্যাডভোকেট আফসার উদ্দিন, কবীর চৌধুরী, ড. এম আর খান, ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী বিএনপির প্রথম কমিটির সদস্য ছিলেন।
এদের বাইরে তুষার কান্তি বারবি, সুনীল গুপ্ত, রেজাউল বারী ডিনা, আনিসুর রহমান, আবুল কাশেম, মনসুর আলী সরকার, আবদুল হামিদ চৌধুরী, মনসুর আলী, শামসুল হক, খন্দকার আবদুল হামিদ, জুলমত আলী খান, অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা, মাহবুব আহমেদ, আবু সাঈদ খান, মোহাম্মদ ইসমাইল, সিরাজুল হক মন্টু, শাহ বদরুল হক, আবদুর রউফ, মোরাদুজ্জামান, জহিরুদ্দিন খান, সুলতান আহমেদ চৌধুরী, শামসুল হুদা, সালেহ আহমেদ চৌধুরী, আফসার আহমেদ সিদ্দিকী, তরিকুল ইসলাম, আনোয়ারুল হক চৌধুরী, মাইনুদ্দিন আহমেদ, এমএ সাত্তার, হাজী জালাল, আহমদ আলী মন্ডল, শাহেদ আলী, আবদুল ওয়াদুদ, শাহ আবদুল হালিম, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, আতাউদ্দিন খান, আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী এবং আহমদ আলীকেও বিএনপির প্রথম কমিটিতে রেখেছিলেন জিয়াউর রহমান।
বিএনপির প্রথম কমিটিতে স্থান পাওয়া অন্তত চার সদস্য পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে গভীর রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে বিএনপির ১ নম্বর তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন ৩০ নম্বর সদস্য আব্দুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ সালের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি রাষ্টপতি ছিলেন। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি মারা যান। জিয়াউর রহমান এবং বিচারপতি আবদুস সাত্তারের পর বিএনপি মনোনীত তৃতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন আব্দুর রহমান বিশ্বাস।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দলটির প্রথম কমিটির ৯ নম্বর সদস্য ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি চৌধুরী) রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বিএনপি মনোনীত তৃতীয় রাষ্ট্রপতি। প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিবও ছিলেন বি. চৌধুরী। ২০২৪ সালের ৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
২০০২ সালে একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন ৭২ নম্বর সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার। একাধিকবার জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। বর্তমান বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ।
এছাড়া বিএনপির প্রথম কমিটিতে স্থান পাওয়া নেতাদের মধ্যে মশিউর রহমান যাদু মিয়া, শাহ আজিজুর রহমান, সাইফুর রহমান, কে এম ওবায়দুর রহমান ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এসএ বারী এটি, ডা. এম এ মতিন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তরিকুল ইসলাম বিএনপিসহ বিভিন্ন সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তবে বিএনপির প্রথম কমিটির ৭৬ জনের মধ্যে ৭৪ জনই মৃত্যুবরণ করেছেন। মাত্র দু’জন সদস্য বেঁচে আছেন। তারা হলেন- ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এদের মধ্যে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বর্তমানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বহুবছর আগে বিএনপি থেকে বেরিয়ে গেছেন। বর্তমান তিনি জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) চেয়ারম্যান।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিকে মধ্যপন্থী উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে রূপ দিতে নানা মত ও পথের ব্যক্তিদের প্রথম কমিটিতে স্থান দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও ছিলেন, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, কিন্ত রাজনীতি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এসব ব্যক্তিদের দলে টেনেছিলেন জিয়াউর রহমান।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান ছিলেন দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশকে একটা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে সব মত ও পথের মানুষকে এক প্ল্যাটফর্মে আনতে হবে। সে কারণে বিএনপির প্রথম কমিটিতে রাজনীতিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, গবেষক, বিচারপতি, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, লেখক, বুদ্ধিজীবী— সবাইকে স্থান দিয়েছিলেন। এবং তিনি তার উদ্দেশ্য সাধনে সফলও হয়েছিলেন।’