Monday 01 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এনবিআরের গুরুত্বপূর্ণ শাখায় লোকবল সংকট!

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:০৭ | আপডেট: ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:৩০

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ফাইল ছবি

ঢাকা: দেশের মোট রাজস্বের প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ ও আয়করের সাড়ে ২৩ শতাংশ আহরণ করে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) আয়কর শাখা। কিন্তু, এই ইউনিটে করদাতার সংখ্যা বাড়লেও এর সেবার পরিধি বাড়েনি। বরং, ২০১১ সালে চালু করা এলটিইউ’র চট্টগ্রাম শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয় ২০২৪ সালে। বর্তমানে চাহিদার প্রায় অর্ধেক কর্মকর্তা দিয়ে চলছে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণকারী ঢাকার এলটিইউ আয়কর শাখা।

কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, এনবিআরে অবহেলিত এলটিইউ ট্যাক্স। এখানে একজনকে করতে হচ্ছে তিনজনের কাজ। এই শাখা থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হলেও কর্মকর্তার অভাবে সেই লক্ষ্য পূরণ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

এনবিআরের তথ্যমতে, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) এর করদাতার সংখ্যা বর্তমানে ১ হাজার ১৫৫। এর মধ্যে স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতা ৭৫২ জন ও কোম্পানি করদাতা ৪০৩। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) এর আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৩ হাজার কোটি টাকা, বিপরীতে আদায় হয় ২৮ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলটিইউ আয়করের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বিপরীতে আদায় হয় ৩০ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা।

তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায় ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়কর থেকে আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৯০ কোটি টাকা। আর অর্থবছরটিতে এলটিইউ ট্যাক্সের আয়কর আদায়ের পরিমাণ ৩০ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, যা মোট আয়কর আদায়ের সাড়ে ২৩ শতাংশ এবং মোট রাজস্বের ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।

জানা গেছে, এলটিইউ আয়করে কর কমিশনার, অতিরিক্ত কর কমিশনার, যুগ্ম কর কমিশনার, উপ-কর কমিশনার, সহকারী কর কমিশনার ও কর পরিদর্শকের মতো কর্মকর্তাদের দায়িত্ব রয়েছে। এসব দায়িত্বে ৪৩ জন কর্মরত থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ২৩ জন। শূন্য পদ রয়েছে ২০টি।

তথ্যমতে, যুগ্ম কর কমিশনারের চার পদে কর্মরত রয়েছেন তিনজন। উপ-কর কমিশনার পদে ১৯ জন থাকার কথা থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র আটজন। এখানে শূন্য পদ ১১টি। সহকারী কর কমিশনার পদে সাতটির বিপরীতে শূন্য পদ ছয়টি। আর ১০ কর পরিদর্শক পদে শূন্য পদ দু’টি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুগ্ম-কর কমিশনার, উপ-কর কমিশনার ও সহকারী কর কমিশনাররাই মূলত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ফাইল নিয়ে কাজ করেন। রাজস্ব আদায়ের মূল কাজটি তারা করে থাকেন। আর এসব পদেই এখন লোকবল শূন্য। তবে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) আয়করে অনুমোদিত পদ ১৩৮টি। বর্তমানে কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে এই দফতরে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৯৭ জন। বিপরীতে শূন্য পদের সংখ্যা ৪১। নিচের দিকের পদগুলোতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরপত্তা প্রহরী, অফিস সহায়ক, দফতরী, মেশিন অপারেটর, গাড়িচালক, কম্পিউটার অপারেটর ও সাঁটলিপিকারের মতো পদ রয়েছ। আর এসব পদে শূন্যতা নেই বললেই চলে।

জানা গেছে, দেশে কর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নে এনবিআরের অধীনে বৃহৎ করদাতা ইউনিট গঠিত হয়। পরে রাজস্ব আহরণের গতি বাড়াতে একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১১ সালে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ঢাকা এর অধীনে চট্টগ্রামে একটি শাখা চালুর মাধ্যমে চট্টগ্রামে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়, যা বৃহৎ করদাতা ইউনিট (চট্টগ্রাম শাখা) নামে পরিচিত হয়।

তবে, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কয়েক বছরে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চট্টগ্রাম শাখায় রাজস্বের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য না হওয়া এবং সেখানকার ইউনিটের নথির সংখ্যা কম হওয়ায় ওই শাখা ২০২৪ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার এক আদেশে বলা হয়, নথি সংখ্যা ও রাজস্ব আহরণের বিবেচনায় বৃহৎ করদাতা ইউনিট চট্টগ্রাম শাখার কার্যক্রম পরিচালনা করতে অফিস ভবন ভাড়াসহ বিপুল পরিমাণে প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে।

এছাড়াও বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কর কমিশনার, অতিরিক্ত কর কমিশনার ও যুগ্ম-কর কমিশনাররা ঢাকাস্থ কার্যালয়ে অবস্থান করায় দূরত্বের কারণে রাজস্ব আহরণ ও উৎসে কর কর্তন সংক্রান্ত কার্যক্রমের সুষ্ঠু মনিটরিংসহ গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউ’র চট্টগ্রাম শাখার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেখানকার ফাইলগুলো চারটি কর অঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলটিইউ ট্যাক্স-এর শীর্ষ এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কর্মকর্তা কম থাকলেও আমাদের প্রবৃদ্ধি রয়েছে। আমরা বেশি কাজ করছি। তিনজনের কাজ একজন করছি। দীর্ঘদিন ফাঁকা থাকলেও নতুন লোকবল নিয়োগ হয়নি।’

সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা ফাইল এসেসমেন্ট করবে, সেই পদগুলোতেই লোকবল নেই। ফলে একজনের উপর বহু ফাইলের চাপ রয়েছে। অথচ এই ইউনিটই আয়করের প্রাণ। সেখানেই কর্মকর্তা কম। সবগুলো পদে লোকবল থাকলে এলটিইউ ট্যাক্স থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায় হতো।’ তবে লোকবল কম থাকার বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এলটিইউ এর কর কমিশনার ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ মামুন।

জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় সব বিভাগেই লোকবল ঘাটতি রয়েছে। দক্ষ জনবল থাকায় এসব জায়গায় কোনো সমস্যা হয় না। স্বচ্ছ ও কর্মঠ লোকজনকে এলটিউতে দিতে হয়। কারণ, যাকে তাকে এলটিইউতে দেওয়া যায় না। আর যেকোনো বিভাগেই উপরের পর্যায়ে লোকবল কম থাকে। পরিপূর্ণ থাকলে তো কাউকে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না।’ এলটিইউতে লোকবলের ঘাটতিকে সহনীয় মাত্রা বললেন তিনি।

মন্তব্য জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এলটিইউ গঠনের প্রায় দুই দশক হতে চলেছে। এই সময়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কিছু কোম্পানিকে দিয়ে এই ইউনিটের যাত্রা শুরু হলেও এখন এখানে অনেক কোম্পানি ও ব্যক্তি করদাতা রয়েছেন। লক্ষ্য ছিল, যারা বড় করদাতা তারা ভালো সেবা পাবেন এবং সঠিকভাবে তাদের মনিটরিং করা যাবে। যেহেতু অর্থনীতি বড় হয়েছে, তাই এলটিইউ’র পরিসর বাড়াতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যদি আরও লোকবল নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে কর আদায়ের পরিমাণও বাড়বে। এনবিআরের সেদিকে মনযোগ দেওয়া উচিত। আর সামগ্রিকভাবে এনবিআরে সব কার্যক্রম আটোমেশন করতে হবে।’ কার্যক্রম আধুনিকায়ন করলে কর ফাঁকি হ্রাস তথা কর আদায়ও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

এনবিআর এলটিইউ শাখা বাড়েনি লোকবল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর