Tuesday 02 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি
রাজসাক্ষী হয়ে অজানা তথ্যের জট খুললেন মামুন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২০:১৯ | আপডেট: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০১:১১

সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: “৪ আগস্ট ২০২৪। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল পুরো দেশ। ঠিক একদিন পরই ‘মার্চ টু ঢাকা’। আর এই কর্মসূচি ঠেকাতে আগের দিন রাতেই গণভবেন ডাকা বৈঠকে নেওয়া হয় নানান পরিকল্পনা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ওই বৈঠকে অংশ নেন শেখ রেহানা ও মন্ত্রীসহ বিভিন্ন বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। ৫ আগস্ট কোথায়-কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেসব সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় বৈঠকে।’

জবানবন্দিতে এমনই সব অজানা তথ্যের জট খোলেন আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে চৌধুরী মামুনের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এদিন বেলা পৌনে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তার সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ৪ আগস্ট গণভবনে বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বেঠকে হয়। বেঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিজিএফআই-এনএসআই প্রধানসহ কমিটির ২৭ জন অংশ নেন। আমি নিজেও ওই বৈঠকে ছিলাম। সেখানে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। এক পর্যায়ে বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর মধ্যেই চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠক মুলতবি করা হয়।’

মামুন বলেন, “ওই রাতেই আমাদের আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আনিসুল, কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র‍্যাব ডিজি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও ছিলেন। আর বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন ডিজিএফআই ও এসবিপ্রধান। ওই বেঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এর পর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে ফোর্স মোতায়েন করে কাঠোর অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা চলে আসি।”

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দফতরে যাই। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনেতা প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২ থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা আমরা জানতাম না। এর পর বিকেলে আর্মি হেলিকপ্টার এসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয় আমাকে। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবিপ্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা। পরের ধাপে হেলিকপ্টারে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যান্যদেরও সেখানে নিয়ে আসা হয়। ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে আমার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন ৩ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেফতার করা হয়।’

এই রাজসাক্ষী বলেন, “২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও প্রদর্শন করেন ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন যে, ‘গুলি করি একজন মরে, একজন আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না’।”

চৌধুরী মামুন বলেন, ‘১৮ জুলাই আমাকে ফোন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সময় আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। আমার সঙ্গে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়ও ছিলেন। নির্দেশনার বিষয়টি জানানোর পর ডিএমপি কমিশনারসহ সারাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেন প্রলয়। এর পর থেকেই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। তবে মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতিউৎসাহী ছিলেন হাবিব ও ডিবির হারুন। মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল যেকোনোভাবে আন্দোলন দমাতে হবে।’

জানা গেছে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীকে প্ররোচিত করেন কামাল, আনিসুল, ফজলে নূর তাপস, সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননসহ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেন আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও ব্যবসায়ীরা।

এ সময় বৈষম্যরিবোধী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের আদেশে ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে হতাহত করায় পুলিশপ্রধান হিসেবে লজ্জিত-অনুতপ্ত প্রকাশ করেন সাবেক এই পুলিশপ্রধান। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাসহ ব্যাপক নৃশংসতার জন্য অপরাধবোধ করছি। এসবে বিবেকের তাড়নায় আমি রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমনকি ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানোদের কান্না-আহাজারি শুনে ও ভিডিওতে নৃশংসতা দেখে রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত আরও যৌক্তিক মনে হয়েছে। বিশেষ করে আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর বীভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে। এছাড়া, আহতদের চিকিৎসায় বাধা নিয়ে দেওয়া চিকিৎসক ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। তবে আমি দায়িত্বে থাকাকালীন এসব সংঘটিত হওয়ায় দায় স্বীকার করছি। একইসঙ্গে গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার, আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।’

ট্রাইব্যুনালে এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা। ১১তম দিনের মতো আজ সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ। তবে জেরার জন্য বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি রাজসাক্ষী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর