ঢাকা: শীর্ণ হাত কাঁপছে। চোখে ক্লান্তির ছাপ। কানে শুনতেও কষ্ট হয়। কিন্তু তবুও জীবন থেমে নেই ফজিলাতুন্নেছার। হাত উঁচু করে বলেন, হ্যাঁ, আমি একা। কিন্তু কারও ধার ধরি না। আমি আল্লাহর রাসূলের ধারধারী।
এক হাতে চাকু, অন্য হাতে হার না মানা সংসার। এ যেন হার না মানা এক নারীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। শত বছর পেলেও আজও তিনি মাথা উঁচু করে বেঁচে আছেন। আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচার কী এক অপূর্ব উদাহরণ।
চাঁদপুরের কদমতলি ভূঁইয়া বাড়ির মেয়ে ফজিলাতুন্নেছা। মা মারা গিয়েছেন ছোটবেলায়। বড় হয়েছেন নানীর কাছে। এক সময় যাওয়া হতো, এখন সে পাটো চুকেছে। বলেন, মামারা থাকতে যাইতাম।
৪৭ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে বসবাস। সাতশ টাকার ভাড়া বাড়িতে একাই থাকেন তিনি। নেই কোনো সন্তান। স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করতেই চোখ ভিজে ওঠে তার। বলেন, নাগো ভাই, এইডি মনে উডাইস না। মনে উডাইলেই…
সকালবেলায় এক কাপ চা-বিস্কুট কিংবা চিঁড়া-মুড়ি খেয়েই বেরিয়ে পড়েন কাজে।
ফজিলাতুন্নেছা থাকেন নগরীর দেওভোগ পাক্কারোডের খানকা গলি এলাকায়। বয়স প্রায় ১১৫ বছর। ছেলে সন্তান ও স্বামী সবাই তাকে অনেক আগেই ছেড়ে চলে গেছেন। ভাড়া বাসার ঘরে থাকার মতো কোনো রকম আছে একটা বিছানা। নগরীর চুনকা পাঠাগারে তিনি যুগের পর যুগ আমড়া, পেয়ারা, কামরাঙা, জাম বিক্রি করেন ন্যায্য মূল্যে। তাও যে আমড়া অন্য জায়গায় বিক্রি হয় ১০ টাকায়, তিনি তা বিক্রি করেন মাত্র ৫ টাকায়। তাই ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণীরা সকল ক্রেতাই তাকে ভালোবাসে।
দুপুরে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করলে মাথা তুলে বলেন, আল্লাহ খাওয়াবেন। অভাব আছে, অক্ষমতা আছে, কিন্তু হাত পেতে খাওয়ার অভ্যাস নেই তার। আমার খাবার আল্লাহ পাঠিয়ে দেন।
বয়স তার শরীরকে দুর্বল করেছে ঠিকই, কিন্তু মনোবল আজও অটুট। ভিক্ষা না করে পরিশ্রম করে জীবন চালান। তার মুখের মলিন অথচ শান্ত হাসিটি যেন বলছে, বাঁচা মানেই যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে পরাজয় মানেই নিজেকে বিসর্জন। আজ যেখানে শহরের অলিগলিতে সুস্থ মানুষ হাত পেতে চলতে শিখেছে, সেখানে ফজিলাতুন্নেছার মতো নারীরা আমাদের শেখান মানসিক শক্তিই সবচেয়ে বড়।
বয়স তার কাছে শুধু একটি সংখ্যা। জীবনের মানে তিনি খুঁজে পান আত্মমর্যাদা ও অদম্য সংগ্রামে। অদম্য এই সংগ্রামী নারীর গল্প শুনে তার কাছে ছুটে যান সারাদেশে মানবিক ডিসি হিসেবে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।
স্থানীয়রা জেলা প্রশাসককে জানান, তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে এই সংগ্রামী নারী নারায়ণগঞ্জে থাকলেও কেউ তার পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি—না জনপ্রতিনিধি, না প্রশাসনের কেউ।
একান্তে ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন ডিসি জাহিদুল ইসলাম মিঞা। জেলার অভিভাবক এবং তার সঙ্গে থাকা অনেকের চোখ ভিজে যায়।
তার অভূতপূর্ব মানবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নগরীর চুনকা পাঠাগারের সামনে শতবর্ষী ফল বিক্রেতা ফজিলাতুন্নেছাকে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে উপহার সামগ্রী হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী—চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবণ, পিঁয়াজ, আলু, কেক, বিস্কুট, রুটি, নুডলস ও গৃহস্থালি বিছানার চাদর, পরনের নতুন কাপড় এবং তার ব্যবসার পুঁজি বৃদ্ধির জন্য নগদ দশ হাজার টাকা উপহার দেন জেলা প্রশাসক।
ফজিলাতুন্নেছার আত্মমর্যাদার ভূয়সী প্রশংসা করে জেলা প্রশাসক বলেন, আমি যখন এখানে উনার কাছে এসেছি, প্রথমে তিনি আমাকে জানান আমি কাজ করে খাবো। আমি কারও সাহায্য নেবো না। আমি তার আত্মমর্যাদাবোধকে সম্মান জানাই। তার জীবনে অনেক সংগ্রাম এসেছে। তিনি স্বামীহারা হয়েছেন। কিন্তু তিনি আত্মসম্মানের সঙ্গে কোনোদিন আপস করেননি।
তিনি বলেন, এই ফজিলাতুন্নেছা যদি তার আত্মসম্মান বজায় রেখে এভাবে কাজ করতে পারেন, আমরা যারা এই সমাজে আছি, তারাও যদি এমনভাবে আত্মসম্মান বজায় রেখে কাজ করতে পারি, তাহলে এই সমাজ অনেক সুন্দর হবে। আমরা চেষ্টা করছি তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তার বয়স্ক ভাতা চালু করতে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ফজিলাতুন্নেছার মতো এমন কেউ থাকলে তাদেরকেও আমরা বয়স্ক ভাতার আওতায় নিয়ে আসব।
তিনি বলেন, শতবর্ষী ফজিলাতুন্নেছার বয়সের বাঁধা অতিক্রম করে এখনও আত্মসম্মান বজায় রেখে কারো সাহায্যের অপেক্ষা না করে নিজের জীবিকা নিজে অর্জনের এই সংগ্রাম সকলের জন্য অনুসরণীয়।
ফজিলাতুন্নেছার এই সংগ্রাম আমাদের বাংলার আবহমান কালের মা-বোনদের সংগ্রামী মনের পরিচায়ক বলে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। জেলা সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে ফজিলাতুন্নেছার বয়স্ক ভাতার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে প্রদানের জন্য তাৎক্ষণিক নির্দেশনাও দেন।
জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম জানান, সমাজসেবা অফিসার নিজের নামে সিম তুলে প্রতি তিন মাস পরপর ফজিলাতুন্নেছাকে বয়স্ক ভাতা তুলে দিয়ে আসবেন।
পাশাপাশি তিনি আরো জানান, ফজিলাতুন্নেছার মতো যারা নিজেদের জীবনসংগ্রাম সকল বাঁধা-বিপত্তি এড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, জেলা প্রশাসন সবসময় তাদের পাশে দাঁড়াবে এবং পর্যায়ক্রমে তাদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হবে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আলমগীর হুসাইন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা) নাইমা ইসলাম, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক, জেলা ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এবং অন্যান্য দফতরের কর্মকর্তারা।