ঢাকা: দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, পাশাপাশি মৃত্যুর খবরও আসছে উদ্বেগজনক হারে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগির চাপ বেড়ে চিকিৎসা সংকট দেখা দিয়েছে। আর এমনটা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ গড়তে পারে ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাস।
গত বছরের চেয়ে চলতি বছর দিগুণ হারে বেড়েছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ, যা প্রকট আকার ধারণ করছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। কিন্তু, জুলাই-আগস্টে ডেঙ্গুতে ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৬৬৯ জন এবং ওই মাসে ডেঙ্গুতে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আর ওই বছরের আগস্টে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৩২৪ জন এবং মারা যায় ২৬ জন। এছাড়া, গত বছরের এই সময়ে অর্থাৎ আগস্ট মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১২ হাজার ৮৪১ জন এবং মৃত্যু হয় ৮৩ জনের।
২০২৫ সালের ডেঙ্গুর পরিস্থিতিতে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। গতবছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ দিগুণের চেয়ে বেশি এবং মৃত্যুও প্রায় দিগুণ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্টে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ৪৯৬ জন এবং মৃত্যু হয় ৩৯ জনের। আর চলতি বছরের জুলাইয়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করে। এই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ৬৮৪ জন এবং মৃত্যু হয় ৪১ জনের। এছাড়া, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩১ হাজার ৪৭৬ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১২২ জনের।
২০১৪ ও ২০২৫ সালের বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, গতবছরের চেয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ হাজার ৬৩৫ জন বেশি। আর এই সময়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি ৩৯ জন। আর ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যায় নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা অনেক বেশি।
এদিকে, রাজধানী ঢাকার চেয়ে বরং বাইরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগ অন্যতম। এর পর রয়েছে- চট্টগ্রাম, ঢাকার দুই সিটি, খুলনা ও ময়মনসিংহ বিভাগ। এসব জায়গায়ও এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে। ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনুযায়ী এডিস মশা নিধনে র্কতৃপক্ষের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয় বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার বিস্তার শুরু হয় সাধারণত জুনে। এ সময় বৃষ্টিতে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে লার্ভা জমে। বৃষ্টির পর তাপ বাড়লে এই পানিতে জমে থাকা এডিসের ডিম দ্রুত পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয়। যদি ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে বিশেষ করে বর্ষাকাল ও সেপ্টেম্বর মাসে, তাহলে ২০২৫ হতে পারে ভয়াবহ ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাস।
গতবারের চেয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধির বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। পানিতে ঢিল মারার পর ঢেউয়ের মতো ডেঙ্গুও একটা সেন্টার থেকে বিস্তৃতি হতে থাকে। মশারা ট্রাভেল করে একটা নতুন জায়গায় অবস্থান নেয়। এভাবেই ডেঙ্গু ধীরে ধীরে বাড়ে- এটা একটি কারণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে, এখন স্থানীয় সরকার প্রশাসন যে কাঠামো আছে, সেটি অনেক জায়গায় ঠিক মতো ফাংশন করছে না। অনেক জায়গায় কাউন্সিলর ও মেয়ররা পালিয়েছে, সেসব জায়গায় কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে না। এই দুটো কারণে ডেঙ্গু বাড়ছে। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনেরও কারণ রয়েছে। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি কমতে আরও সময় লাগবে, অক্টোবর পর্যন্ত এই ধাক্কাটা যাবে।’
ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা যায়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রোগীর সঠিক তথ্য ও ঠিকানা সংগ্রহ করতে হবে। ডেঙ্গু রোগী কোন বাসায় আক্রান্ত হয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। ম্যানেজমেন্ট হটস্পট বলতে বুঝায়- ওই বাড়িকে কেন্দ্র করে ২০০ মিটারের মধ্যে ফগিং করে উড়ন্ত মশা মারা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, ওই উড়ন্ত মশা যদি বেঁচে থাকে তাহলে তারা জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু ছড়াবে। আরকেটা হচ্ছে- ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজম্যান্ট। ডেঙ্গু বা এডিস মশা হয় মূলত জমা পানিতে। এই জমা পানি কোনোভাবেই রাখা যাবে না। বাড়ির আঙিনায় যেন জমা পানি না থাকে। আর সিটি করপোরেশনকে রাস্তাঘাট ও অফিসগুলোতে ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজম্যান্ট করতে হবে। এই দুটো কাজ যদি একসঙ্গে করা যায় তাহলে ডেঙ্গু বা এডিস মশার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম মুশতাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবছরের তুলনায় এবার মশার প্রকোপ বেশি। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ না নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। চিকিৎসা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমাদের জানা আছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাজেট বাড়াতে হবে এবং মশক নিধনে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তাদেরকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।’