ঢাকা: মোবাইল টার্মিনেশন রেট (এমটিআর) ফান্ডে অব্যবহৃত পড়ে থাকা প্রায় ২২০ কোটি টাকা ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে দেশের তিন মোবাইল অপারেটর রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক। আগে এই ফান্ডের অর্থ ব্যবহারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পূর্বানুমতি লাগতো। তবে বর্তমানে এই ফান্ডের অর্থ ব্যয় করতে হবে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক বা সেবা সম্প্রসারণে। ফলে সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) অর্জনকারী ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের আধিপত্য কিছুটা হলেও কমবে। বিটিআরসির এই সিদ্ধান্তে টেলিকম খাতে আরও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ফিরে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে, ইন্টারকানেকশন চার্জের বৈষম্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন।
জানতে চাইলে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ-উল-বারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিটিআরসির লক্ষ্য হচ্ছে অপারেটরগুলোর মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর করা। এ কারণেই নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে এমটিআর ফান্ডের অর্থ পূর্বানুমতি ছাড়াই ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর এই টাকাটি তাদের, তাদের অর্থই তারা ব্যবহার করবে।’
বিটিআরসির চেয়ারম্যান আরও জানান, নন এসএমপি অপারেটগুলো যাতে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ পায় তা নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত। কারণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ না হওয়ার কারণেই এসএমপি অপারেটরের নেটওয়ার্কের ধারেকাছে নেই নন-এসএমপি তিন অপারেটর। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতেই তিন অপারটরকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনকে এসএমপি বা তাৎপর্যপূর্ণ বাজার ক্ষমতাধর হিসেবে ঘোষণা করে বিটিআরসি। ওই ঘোষণার ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে গ্রামীণফোনের করণীয় ও বর্জনীয় নির্ধারণ করতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই খাতের বাকি তিন অপারেটর রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক ও টেলিটক নন-এসএমপি অপারেটর হিসেবে পরিচিত।
তথ্যমতে, এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরের নম্বরের কল করলে দ্বিতীয় অপারেটরকে প্রথম অপারেটরের একটি নির্দিষ্ট অর্থ পরিশোধ করতে হয়। জানা গেছে, ২০২০ সালের জুলাইয়ের আগে সকল মোবাইল অপারেটররা একে অপরের নেটওয়ার্কে কল করলে প্রতিমিনিট বাবদ অন্য অপারেটরকে ১০ পয়সা দিতে হতো। তবে ভিন্ন মোবাইল টার্মিনেশন রেট চালু হওয়ার পর বর্তমানে অভিন্ন এমটিআর রয়েছে। গ্রামীণফোন থেকে রবি বা বাংলালিংক কোন নম্বরে কল দিলে গ্রামীণফোনকে এমটিআর দিতে হয় ১০ পয়সা। অনুরুপভাবে রবি বা বাংলালিংক থেকে গ্রামীণফোনে কল গেলে রবি বা বাংলালিংককে পরিশোধ করতে হয় প্রতি মিনিটে ৭ পয়সা। নন-এসএমপি অপারেটরকে এমন কলে মিনিট প্রতি ৩ পয়সা করে এমটিআরের পৃথক অ্যাকাউন্টে জমা রাখতে হতো এবং কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত কাঠামোতে খরচ করতে হতো। তবে এখন থেকে তা আর জমা রাখতে হবে না। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ ছিল। এই নির্দেশনার ফলে তিন অপারেটরের জমা রাখা প্রায় ২২০ কোটি টাকা এখন ব্যবহার করতে পারবে।
অপারেটরগুলো বলছে, আগে আলাদা অ্যাকাউন্টে অর্থ রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন তা থাকছে না। এমটিআর ফান্ডের অর্থ অপারেটরগুলোর অন্য একটি অ্যাকাউন্টে রাখতে হতো। অব্যবহৃত থাকা ওই অর্থ বর্তমানে ব্যবহার করা যাবে। আর বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এমটিআর নেই বলেও জানায় কয়েকটি অপারেটর।
বিটিআরসির এক কমিশন বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিটিআরসির অনুমোদন সাপেক্ষে খরচ করা বাধ্যবাধকতা প্রয়োগের পর তিন অপারেটরের প্রায় ২২০ কোটি টাকা অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের এমটিআর ফান্ডে জমা থাকা অবশিষ্ট টাকার পরিমাণ ১১০ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার ৩৮০ টাকা। বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের এই ফান্ডে জমা আছে ৭৯ কোটি ৮৮ লাখ ৫২ হাজার ২৫৮ টাকা। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের এই ফান্ডে জমার পরিমাণ ৩০ কোটি ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭ টাকা।
কমিশন বৈঠকের এক নথিতে বলা হয়, বিটিআরসি’র অনুমোদন সাপেক্ষে খরচ করার বাধ্যবাধকাতা প্রয়োগের পর তিন অপারেটর মিলিয়ে প্রায় ২২০ কোটি টাকা অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। ফলে এটি টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। নন-এসএমপি অপারেটররা তাদের জন্য ন্যায্য এই সুবিধা কাজেও লাগাতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ বাজার ক্ষমতা পরিচালনাকারীর ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ অনুযায়ী নন-এসএমপি অপারেটরের প্রাপ্ত এমটিআর এর ০.০৩ টাকা/মিনিট হতে জমাকৃত খাতের অর্থ ব্যয়ে ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির নির্দেশনা অনুযায়ী আরোপিত বিটিআরসি অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা শিথিল করে।
অর্থাৎ ওই পত্রটি বাতিল করে, ২০২১ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত খাতে ব্যয় পূর্বক কমিশনকে অবহিত করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। সেইসঙ্গে ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল তারিখের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যয়ের প্রতিবেদন ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কমিশনে অবহিত করার পরিবর্তে অর্থবছর শেষে অবহিত করার নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। তবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নন-এসএমপি অপারেটরদের সেবার মানোন্নয়ন, নিজেদের পরিকল্পনা মোতাবেক খাত নির্ধারণ করে ব্যয়ের স্বাধীনতা দেওয়া হলে নন-এসএমপি অপারেটররা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে সুযোগ বেশি পাবে। এবং এটি তাদের ন্যায্য অধিকার।
সম্প্রতি এক কমিশন বৈঠকে নন-এসএমপি অপারেটরদের জন্য মোবাইল টার্মিনেশন রেট (এমটিআর) বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে নন-এমএসএমপি অপারেটররা এসএমপি নীতিমালা অনুযায়ী এমটিআর হতে ৩ পয়সা মিনিট হারে প্রাপ্ত অর্থের পৃথক হিসাব (একাউন্টেবিলিটি) রক্ষা করবে। ওই অর্থ সংশ্লিষ্ট অপারেটররা দুর্গম, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক বা সেবা সম্প্রসারণের কাজে ব্যয় করবে এবং সংশ্লিষ্ট অপারেটররা ষান্মাসিক ভিত্তিতে (জানুয়ারি থেকে জুলাই) কমিশনের কাছে ওই অর্থের স্থিতি ও এর ব্যয়ের হিসাব-উপস্থাপন করবে।
জানতে চাইলে রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অমিংমাসিত ইস্যু সমাধানের জন্য বিটিআরসিকে ধন্যবাদ। এসএমপি প্রবিধানের অধীনে ২০২০ সালে বিটিআরসি কর্তৃক নির্ধারিত ২০টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র তিনটি বিষয়ে বাধ্যবাধকতা কার্যকর করা হয়। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে ভিন্ন মোবাইল টার্মিনেশন রেট একমাত্র কার্যকরী বিষয়। বাজারে এসএমপি অপারেটর এখনো অনেক প্রতিযোগিতাবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমরা আশা করি, বিটিআরসি প্রতিযোগিতাবিরোধী কার্যক্রম রোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এমটিআর ফান্ড ব্যবহারে বিটিআরসি’র সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। এই উদ্যোগ নন-এসএমপি অপারেটরদের সেবার মান ও বিস্তৃতি বাড়াতে ফান্ডগুলো ব্যবহার করার সুযোগ দেবে, যা সরাসরি গ্রাহকদের উপকারে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, বিটিআরসি শিগগিরই এসএমপি-সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতাগুলোও পর্যালোচনা করবে, যাতে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার পরিবেশ তৈরি হয় এবং খাতটির দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।’
তবে এমটিআর ফান্ডের ওই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করে গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিসিএও) তানভীর মোহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমটিআর ফান্ড বিষয়ে আমরা শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছি— বিশেষ করে নন-এসএমপি অপারেটরদের এ ফান্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কিনা। এ পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন দেখতে পাইনি। যদিও আগে গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, নিয়ম সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং এর ধারাবাহিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের জানা মতে, বিটিআরসি আটটি নির্দিষ্ট খাতে এই অর্থ গ্রাহকদের কল্যাণে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু আমরা শুনেছি, এই নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। তাই আমরা বিটিআরসিকে অনুরোধ করছি বিষয়টি খতিয়ে দেখে নিয়ম অনুযায়ী অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে।’
ইন্টারকানেকশন চার্জের বৈষম্য প্রত্যাহার করার আহ্ববান জানিয়ে গ্রামীণফোনের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অ্যাসিমেট্রিক ইন্টারকানেকশন রেট কার্যত দক্ষ অপারেটরদের অর্জিত অর্থ, যা কমদক্ষ অপারেটরদের ভর্তুকি দিতে ব্যবহার করছে। এতে দক্ষতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, যা প্রতিযোগিতামূলক বাজার পরিবেশকে ব্যাহত করছে। তাই আমাদের আহ্বান থাকবে, প্রতিযোগিতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি সুষ্ঠু বাজার বিশ্লেষণ না হওয়া পর্যন্ত ইন্টারকানেকশন চার্জে এ ধরনের বৈষম্য প্রত্যাহার করা হোক।’