Friday 05 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুন্দরবনের শত্রু যত!

মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:০৮

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। ছবি: সংগৃহীত

সাতক্ষীরা: দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই বন আজ অস্তিত্ব সংকটে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে বন আজ ধ্বংসের পথে। লবণাক্ততার প্রভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন পশুপাখি, হারিয়ে যেতে বসেছে সুন্দরবনের গঠন। এতে কোণাঠাসা হয়ে পড়ছে সমগ্র উপকূল। আর মানুষের কার্যকলাপে হুমকিতে রয়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গাছপালা, হারিয়ে যাচ্ছে পশু-পাখি, বিলুপ্তির পথে অনেক মাছ ও কাঁকড়া।

 

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকানো না গেলেও মানুষের কিছু অভ্যাস বদল আর কার্যক্রমই পারে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে। যেমন- বনভূমি উজাড় বন্ধ করা, চোরা শিকারি রোধ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পর্যটকদের জন্য নিয়মকানুন তৈরি ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এছাড়া, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সরকারের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন করা জরুরি।

বিজ্ঞাপন

সুন্দরবনের যত সুন্দর

বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। এছাড়াও রয়েছে প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এদের মধ্যে স্তন্যপায়ী রয়েছে ৪২ প্রজাতির, আর উভচর ৩৫ প্রজাতি। সুন্দরবনের বড় বন্যপ্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী এরই সংখ্যা ১২৫টি। ২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, চিত্রা হরিণ আছে প্রায় ২ লাখ, কুমির ১৫০ থেকে ২১০টি, ইরাবতী ডলফিন ৪৫০টির বেশি, শুশুক ২২৫টি, বানর ১ লাখ ৫২ হাজাচর ৪৪৪টি, বন্যশুকর ৪৭ হাজার ৫১৫টি, গুইসাপ ২৫ হাজার ১২৪টি, সজারু ১২ হাজার ১২৪টি।

সুন্দরবনে বসবাসকারী ৩০০ প্রজাতির পাখির অধিকাংশই স্থানীয় বা আবাসিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাছরাঙ্গা, ঈগল, বক, বাজ, মদনটাক, কাঠঠোকরা,চিল, ভীমরাজ, পেঁচা, মাস্কড ফিনফুট ইত্যাদি। এখানে মহাবিপন্ন পাখি হচ্ছে মাস্টকট ফিনফুট। বর্তমানে এর সংখ্যা ২০০ থেকে ২৫০ টির মতো। সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাকড়া ও ৪২ প্রজাতির শামুক ঝিনুক।

বিলুপ্তির পথে যেসব প্রাণী

সাতক্ষীরা বন বিভাগের তথ্য মতে, জাভার গণ্ডার, ভারতীয় গণ্ডার, ভারতীয় হাতি, বুনোমহিষ, চিতাবাঘ, ভারতীয় সিংহ, ময়ূর, বারো সিংগা হরিণ, মগর/ভারতীয় কুমির গাঙ্গেয় শুশুক বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

সুন্দরবনের শত্রুরা

জলবায়ু পরিবর্তন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও মাটির ক্ষয় সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশের ওপর ক্রমাগত বড় প্রভাব ফেলছে। মরুভূমি প্রসারিত হচ্ছে এবং তাপপ্রবাহ ও বনে আগুনের ঘটনা আরও ঘন ঘন ঘটছে। আর্কটিকে উষ্ণতা বাড়ার ফলে চিরহিমভূমি গলছে, হিমবাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং সামুদ্রিক বরফও কমছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘূর্ণিঝড়কে আরও তীব্র করছে। পাশাপাশি খরা ও অন্যান্য চরম আবহাওয়ার ঘটনাও বাড়িয়ে তুলছে। পর্বত অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, প্রবাল প্রাচীর এবং আর্কটিক অঞ্চলে দ্রুত পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে অনেক প্রজাতিকে স্থান পরিবর্তন করতে বা বিলুপ্ত হতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে উষ্ণতা বাড়ার হার সীমিত করলেও কিছু প্রভাব শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মহাসাগরের উষ্ণতা ও অম্লতা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি।

লবণাক্ততা বৃদ্ধি

স্থানীয় মানুষজন বলছে, আইলা পরবর্তী সময় পর থেকে সুন্দরবনসহ উপকূল এলাকায় লবণাক্ততার প্রভাব বেড়ে গেছে। আগে এতটা লবণ ছিলে না। আইলা ও সিডর আসার পর উপকূলের ভেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ফলে সব জায়গায় লবণ পানি প্রবেশ করে। সেখান থেকে উপকূলে লবণাক্ততার প্রভাব বেড়ে যায়। উজানের বাঁধের কারণে মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদী ও খালে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের কারণে প্রায় ৪০ শতাং সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মানুষের কার্যকলাপ

অবৈধ রিসোর্ট স্থাপন, পর্যটকদের আনাগোনা ও বনজ সম্পদ আহরণের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। শিল্পকারখানা ও নৌযান থেকে নির্গত দূষণও সুন্দরবনের পরিবেশকে দূষিত করছে।

যে কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবন

সুন্দরবনের বর্তমানে সম্পদ নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন। বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মাছ, কাঁকড়া, হরিণ শিকার করা বন্ধ না করার কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে শুধু মাছের সংখ্যাই কমছে না, বরং পুরো বাস্তুসংস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রজনন মৌসুমের কতটা বিশ্রামে থাকে সুন্দরবন

দীর্ঘ দিন ধরে সুন্দরবন নিয়ে কাজ করছেন সাংবাদিক মহসিন উল হাকিম। তিনি জানান, প্রজনন মৌসুমের এই তিন মাস কি সুন্দরবন ভালো থাকে? সুন্দরবন কি অত্যাচারমুক্ত থাকে? অবশ্যই না। সুন্দরবনে এখন ফুটেছে বাইন ফুল। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করছে পুরোদমে। বৃষ্টি হচ্ছে। মৌচাকগুলো মধুতে ভরা। প্রবেশ নিষেধ হলেও সেই মধু সংগ্রহে যাবেন মৌয়ালরা। চুরি করেই যাবেন। কারণ তাদের পেটে ক্ষুধা। বর্ষায় সুন্দরবনে মাছ বেশি হয়। চিংড়ি হয় টনকে টন। কিন্তু এই সময়েই বনে প্রবেশ নিষেধ। তার মানে জেলেরা পেট চালাতে চুরি করেই বনে ঢুকবেই। শুধু তাই না, সুন্দরবনে এই সময় চলে বিষ দিয়ে মাছ ধরার মহোৎসব। তাহলে এভাবে কি সুন্দরবন সুরক্ষিত থাকবে?

যা বলছেন জলবায়ুকর্মীরা

ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়কারী সোহানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমরা অনেকদিন ধরে কাজ করে আসছি। কিছু সাফল্য অর্জন করলেও চ্যালেঞ্জ এখনো ব্যাপক। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষ পরিবেশবান্ধব জীবনধারা ও প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিল্পোন্নত দেশগুলো এখনো প্রতিশ্রুত অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা যথাযথভাবে দিচ্ছে না। আর কর্পোরেট মুনাফার লোভ ও ভোগবাদী সংস্কৃতি দূষণ কমানোর পথে বড় বাধা। মানুষের কার্যকলাপ পুরোপুরি থামানো না গেলেও, সঠিক নীতিমালা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সচেতন নাগরিক উদ্যোগের মাধ্যমে দূষণ কমানো সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন একদিনে থামানো যাবে না, কিন্তু যৌথ প্রয়াসে আমরা এর ক্ষতি কমিয়ে একটি ন্যায্য, সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারি।’

তরুণ জলবায়ুকর্মী এস এম শাহীন আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন আজ মানুষের কার্যকলাপে হুমকির মুখে। এই জীববৈচিত্র্যের আধারকে রক্ষা করতে হলে এখনই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সচেতনতা গড়ে তুলছি, প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, স্থানীয় তরুণদের উদ্দীপ্ত করছি পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় হতে। তবে শুধু আমাদের চেষ্টায় চলবে না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরও শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে। তাবেই সুন্দরবন তার স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকে থাকবে।’

যা বলছে বন বিভাগ

সাতক্ষীরা রেঞ্জ সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ফরেস্ট রেঞ্জার রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. ফজলুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুন্দরবন ধ্বংসের পথে বিষয়টি এই মুহূর্তে মানতে নারাজ। তবে কিছু কিছু মানবসৃষ্ট বিষয় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ। বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার ও হরিণ শিকারকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে অনেক আগে থেকে। এছাড়া, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক জলযান চলাচলের চ্যানেল রাখায় পানি, জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক জীবন বা অবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর বংশবিস্তারে বিঘ্নিত হচ্ছে।’

তিনি জানান, তিন মাসের জন্য সুন্দরবন থেকে সবধরনের সম্পদ আহরণ ও পর্যটনের ওপর নিষেধাজ্ঞা সর্বসম্মতিক্রমে বিভিন্ন গবেষণালব্ধ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। প্রকৃতিরও বিশ্রাম প্রয়োজন। বন্ধের এই সময়টাকে রেস্টোরেশনও সময় বলা হয়। এছাড়া মাছ, জল ও জলজ জীববৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যান প্রমাণ সাপেক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান ফজলুল হক।

সারাবাংলা/পিটিএম

জলবায়ু মানুষ্যসৃষ্টি শত্রু সুন্দরবন

বিজ্ঞাপন

মারাকানায় বিধ্বংসী ব্রাজিল
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:২৯

সুন্দরবনের শত্রু যত!
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর