সাতক্ষীরা: বৃষ্টিভেজা দুপুরে সাতক্ষীরার ছোট্ট গালিবকে দেখা যায় হাতে পলিথিনের ব্যাগ, পাশে দাঁড়ানো বাবা। মাথায় সস্তা এক টুকরো প্লাস্টিক জড়িয়ে বৃষ্টিকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে পড়ে থাকা বোতল, খাবারের প্যাকেট আর পলিথিনের ব্যাগ তুলে সে ভরে দিচ্ছে বড় একটি বস্তায়। খেলার বয়সে অন্যদের মতো মাঠে না গিয়ে গালিব ব্যস্ত থাকে পরিবারের জীবিকার টানে প্লাস্টিক কুড়িয়ে আনতে।
এই ছবিটিই যেন আমাদের বাস্তবতা। প্লাস্টিক শুধু পরিবেশ নয়, নিম্নবিত্তের জীবনে হয়ে উঠেছে এক অদৃশ্য বোঝা।
নিষিদ্ধ হলেও থামেনি পলিথিন
বাংলাদেশ সরকার বহু বছর আগে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও বাস্তবে এর ব্যবহার কমেনি। বরং বাজারে বেড়েছে বহুগুণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসচেতনতার ঘাটতি, বিকল্পের অভাব এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
পলিথিন বর্জ্য নদী-খাল ভরাট করছে, কৃষিজমির উর্বরতা কমাচ্ছে, আর পোড়ালে বাতাসে ছড়াচ্ছে মারাত্মক বিষাক্ত গ্যাস। এর প্রভাবে ক্যানসারসহ নানা শ্বাসকষ্টজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন আমাদের খাবার, পানি, এমনকি লবণেও প্রবেশ করছে—অর্থাৎ আমরা নিজেরাই অজান্তে প্লাস্টিক খাচ্ছি।
জলজ প্রাণ থেকে কৃষিজমি: সর্বত্র ক্ষতি
গবেষণা বলছে, প্লাস্টিক বর্জ্য স্থলজ ও জলজ প্রাণীর জন্য প্রাণঘাতী। কচ্ছপ, মাছ কিংবা পাখি—সবাই পলিথিনকে খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে। খাদ্যনালিতে আটকে গিয়ে তা হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুফাঁদ। নদী-নালায় প্লাস্টিক জমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়, বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়। কৃষিজমির মাটিতে প্লাস্টিক থেকে যায় বহু বছর, কমিয়ে দেয় উর্বরতা।
সাতক্ষীরা সদরের স্থানীয়রা বলছেন, একসময় যে এলাকায় ধানক্ষেত চোখে পড়তো, সেখানে এখন কেবল শিল্পকারখানা আর জমি ভরাট। নদীর খরস্রোত কমে আসছে, মাছের সংখ্যা কমছে। সব মিলিয়ে প্লাস্টিক যেন এক ‘নীরব হত্যাকারী’।
প্লাস্টিক ব্যবহার বিত্তশালীদের, ভোগান্তি গরিবদের
প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রায় ৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট কনসার্নের তথ্য বলছে, এর মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়। বাকি অংশ খোলা জায়গা, খাল-বিল বা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। অথচ গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীই এর ভুক্তভোগী। খাল ভরাট হওয়ায় ফসল নষ্ট হয়, নদী দূষিত হয়, জীবিকা হারায় জেলেরা। অথচ প্লাস্টিকের ভোগবিলাসে এগিয়ে থাকে শহরের বিত্তশালী শ্রেণি।
পলিথিন মুক্ত গ্রাম কাঠামারি
তবে সব অন্ধকারের মাঝেই কিছু আলো আছে। বাগেরহাটের কাঠামারি গ্রামে স্থানীয় সংগঠন ইউথ ফর দ্য সুন্দরবন-এর উদ্যোগে চালু হয়েছে প্লাস্টিকমুক্ত কার্যক্রম।
ভিন্ন চিত্রের গ্রামটি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়ন-এর অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে গ্রামের নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করা হয়, দেওয়া হয় পাটের ব্যাগ ও বস্তা। মানুষ প্রতিশ্রুতি দেয়, ব্যবহার করা প্লাস্টিক আর যেখানে-সেখানে ফেলবে না। ধীরে ধীরে পুরো গ্রামই বদলে যায়। উপজেলা প্রশাসন পরে আনুষ্ঠানিকভাবে কাঠামারিকে ঘোষণা করে “প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত গ্রাম” হিসেবে।
কাঠামারি গ্রামের প্রিয়ন্তি মন্ডল জানান, ‘আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন আগে সব যেখানে সেখানে রাখতো। কিন্তু আমরা তাদের সচেতনামূলক বার্তা পৌছে দিয়েছি তাদের বাড়িতে বাড়িতে। ফলে তারা সচেতন হয়ে এখন আর যেখানে সেখানে প্লাস্টিক, পলিথিন ফেলে না। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে পাটের বস্তা আবার ব্যাগ প্রদান করা হয়। দিন শেষে তারা সেখানে এসব ফেলেন। এভাবে একটা গ্রাম আমরা পলিথিন-প্লাস্টিকমুক্ত গ্রাম করতে সক্ষম হয়েছি।’
‘ইউথ ফর দি সুন্দরবন’ সংগঠনের রামপাল প্রতিনিধি তীর্থ সলিল ঠাকুর জানান, ‘কাঠামারি গ্রামের মানুষ সবার মতোই প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার করতো। কারন দৈনন্দিন জীবনের সকল পণ্য প্লাস্টিক ও পলিথিনে দেওয়া হয়। যা আমরা যেখানে সেখানে ফেলে দেই ব্যবহারের পর। এসব বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের নিয়ে একটা উঠান বৈঠক করি। সেখানে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তাদের মাঝে আমরা পাটের ব্যাগ, বস্তা বিতরণ করি। তারপর তারা আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যবহৃত সকল পণ্য তারা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবে। এরপর থেকে তারা প্লাস্টিক-পলিথিনের সবকিছু সেই ব্যাগে জমিয়ে রাখতে শুরু করে। তারপর সেখান থেকে তারা নিদিষ্ট স্থানে ফেলে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় দিন দিন এই গ্রামকে উপজেলা প্রশাসন প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত গ্রাম ঘোষণা করেন। সেখান থেকে কাটামারি গ্রামটা প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত গ্রাম হওয়ার গৌরব অর্জন করে।’
তীর্থ আরো বলেন, ‘আমরা কাঠামারি গ্রামের মতো এভাবে সবাই সচেতন থাকলে একটা গ্রাম শুধু নয়, পুরো দেশ প্লাস্টিক ও পলিথিন মুক্ত করা সম্ভব।’
প্লাস্টিক: জলবায়ুর অদৃশ্য বোমা
জলবায়ুকর্মী সোহানুর রহমান একে বলেছেন ‘জলবায়ু বোমা’। তার মতে, “নদী-নালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে, জমি আর পানি বিষাক্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমরা ধীরে ধীরে নিজেরাই প্লাস্টিক খাচ্ছি।”
তিনি সতর্ক করেন—প্লাস্টিক সমস্যাকে শুধু বর্জ্য হিসেবে দেখলে হবে না। এটিকে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু—তিনটি দিক থেকেই দেখতে হবে। আর সমাধানও হতে হবে কাঠামোগত: উৎপাদন কমানো, নিরাপদ পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধ করা এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প জনপ্রিয় করা।
জাতিসংঘের উদ্যোগ: আশার নতুন দিগন্ত
প্লাস্টিকের উৎপাদন যেহেতু পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে হয়, তাই এটি সরাসরি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের সাথে যুক্ত। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে বৈশ্বিক নিঃসরণের প্রায় ১৯ শতাংশ আসবে প্লাস্টিক শিল্প থেকে।
তবে মূল পদক্ষেপটা নিয়েছে আরেকটি মঞ্চ জাতিসংঘের পরিবেশ সমাবেশ (UNEA) ২০২২ সালে UNEA একটি বৈশ্বিক বাধ্যতামূলক প্লাস্টিক চুক্তি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। লক্ষ্য, ২০২৪–২০২৫ সালের মধ্যে এই চুক্তি চূড়ান্ত করা। এই চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণ শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনা। সেই চুক্তির দরকষাকষি এখনও চলছে।