যশোর : যশোরের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খাবার নিয়ে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও তা বই আকারে লিপিবদ্ধ হয়নি। যদিও কোনো কোনো খাবারের কথা বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তবে তাতে এ অঞ্চলের সব প্রচলিত ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের তথ্য উঠে আসেনি। এবারই প্রথম যশোরের খাবার নিয়ে একটি মৌলিক ও গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হয়েছে।
সম্প্রতি ‘যশোরের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ও খাদ্যাভাস’ নামের বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটি যশোর জেলা প্রশাসন প্রকাশ করেছে। যদিও যশোর জেলা প্রশাসন এর আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ম্যাগাজিন ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে, তবে এটিই তাদের প্রকাশিত প্রথম বই।
বইটি যৌথভাবে লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুর রহমান এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মির্জা আমিরুন নেছা।
ড. হাবিবুর রহমান ১৬টিরও বেশি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা কাজের সঙ্গেও যুক্ত।
বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমাজতত্ত্বের ওপর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে ড. মির্জা আমিরুন নেছার বহু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও, এটিই তার প্রথম মৌলিক গ্রন্থ।
তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে ‘উত্তরাঞ্চলের লোকসাহিত্যে সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি’ বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজশাহীর রাণীবাজারের সরকার প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত আট ফর্মার ‘যশোরের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ও খাদ্যাভাস’ বইটিতে যশোরাঞ্চলের ৬০টিরও বেশি ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খাবারের রান্নার পদ্ধতি, নাম, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং তাতে নারীদের অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি, লেখকদ্বয় খাবারের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন, সহানুভূতি এবং সমাজের অন্তর্নিহিত ঐক্যের দিকটিও ফুটিয়ে তুলেছেন।
বইটি একটি নৃ-সাংস্কৃতিক গবেষণার মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন ও খাদ্যচর্চার চিত্র তুলে ধরেছে, যা যশোর জেলার লোকজ্ঞান ও স্থানীয় ইতিহাসের একটি বিশেষ দলিল হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বলে দাবি করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটি গ্রন্থিত হওয়ার ফলে যশোরের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য একই জায়গায় পাওয়ার পথ খুলে গেলো।
৩৫০ টাকা মূল্যের ১২৮ পৃষ্ঠার বইটি সম্পর্কে জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, যশোরের অনেক ঐতিহ্য আছে, যা বই আকারে একত্রিত করে সংরক্ষণ করা জরুরি। এর পরিচিতি দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে দিতে এবং প্রয়োজনীয় গবেষণার উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসন এই বইটি প্রকাশ করেছে। তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে আরও কিছু সৃজনশীল ও মৌলিক বিষয় নিয়ে বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।
বইটির প্রাককথনে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেছেন, যশোরের গ্রামীণ জনজীবনে দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত এই খাদ্য সংস্কৃতি শুধু পুষ্টি ও স্বাদের বিষয় নয়, বরং এটি এই অঞ্চলের মানুষের অর্জিত জ্ঞান, আবহমানকালের কৃষি প্রথা, ঋতুভিত্তিক জীবনযাপন, নারীর অবদান, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সামাজিক সংহতির প্রতিফলন। এ কারণেই নানা ধর্ম, জাতি ও পেশার মানুষ এই অঞ্চলে সহাবস্থান করে একটি বহুমাত্রিক খাদ্য ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন, যা গবেষণা ও সংরক্ষণের দাবি রাখে।
বইটির ‘প্রসঙ্গ-কথা’ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামের যেকোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে স্থানীয় খাবার পরিবেশন করা আবশ্যক। যেমন: ছিটে রুটি, চুষি পিঠা, ভাপা পিঠা, ডিম-আমড়ার খাট্টা, চুঁইঝাল খাসির মাংস, শুঁটকি ভুনা ইত্যাদি। এই খাবারগুলো কেবল স্বাদের জন্য নয়, বরং পারিবারিক ঐতিহ্য ও নারীর হাতের তৈরি শিল্পকর্ম। এগুলো স্থানীয় ইতিহাস, বিশ্বাস, প্রকৃতি, জীবন সংগ্রাম এবং সামাজিক বন্ধনেরও সাক্ষী।
বইটিতে আরও বলা হয়েছে যে, যশোরের ছনবাড়িয়ার গুড়, মণিরামপুরের শুঁটকি এবং চৌগাছার চালতার আচারের মতো খাবারগুলোকে জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। খাদ্য এখন শুধু একটি স্থানীয় চর্চা নয়, এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি শক্তিশালী খাত এবং একটি ব্র্যান্ডিং-যোগ্য সাংস্কৃতিক সম্পদ।
যশোর জেলা প্রশাসন মনে করে, যে যাত্রা এখান থেকে শুরু হলো, তা ধারাবাহিক রাখা জরুরি। এর মাধ্যমে যশোরকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা সম্ভব হবে।