Saturday 13 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কক্সবাজারে দন্ত চিকিৎসা: সরকারি অব্যবস্থাপনায় প্রাইভেট বাণিজ্যের ফাঁদ

ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫১ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:০৮

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে দন্ত চিকিৎসায় নামমাত্র সেবা। ছবি: সারাবাংলা

কক্সবাজার: দাঁত শুধু সৌন্দর্যের নয়, মানবদেহের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। দাঁতের সামান্য সমস্যাও মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করতে পারে। অথচ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে দাঁতের চিকিৎসা ব্যবস্থাই যেন এক অদৃশ্য সংকটের নাম। সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, লোকবল ও যন্ত্রাংশ সংকট, আর প্রাইভেট চিকিৎসার লাগামহীন খরচ—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগের তৃতীয় তলায় প্রতিদিন দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসেন এক থেকে দেড় শতাধিক রোগী। কিন্তু চিকিৎসা পান মাত্র ১০–১২ জন। বাকিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় প্রেসক্রিপশন, কিছু ওষুধ আর চট্টগ্রাম রেফারের কাগজ। চিকিৎসকরা দায় এড়ানোর কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন জনবল সংকট ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব।

বিজ্ঞাপন

ফলে দাঁতের রোগীরা বাধ্য হচ্ছেন ব্যয়বহুল প্রাইভেট চেম্বারের দ্বারস্থ হতে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা হাসপাতালের সেবা পাচ্ছেন না আবার প্রাইভেট চেম্বারের ভারী খরচও বহন করতে পারছেন না।

ব্যয়বহুল চিকিৎসার সঙ্গে কুয়াক ডাক্তারদের ফাঁদ

দন্ত চিকিৎসা যে কতটা ব্যয়বহুল—এর কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে ভ্রাম্যমাণ কুয়াক (ভুয়া) ডাক্তাররা। তারা নামমাত্র খরচে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করছে। নিম্নমানের ওষুধ আর অনুপযুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দিচ্ছে ভুল চিকিৎসা, যা অনেক সময় রোগীদের স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দাঁত ফেলা কোথাও দুই হাজার, কোথাও পাঁচ হাজার টাকা। রুট ক্যানেল কোনো জায়গায় তিন হাজার, আবার কোথাও ১০–১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এমনকি স্কেলিং বা ফিলিংয়ের খরচেও ব্যাপক তারতম্য। চিকিৎসকের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণের এই বৈষম্য ভোগান্তি বাড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের। একদিকে সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, অন্যদিকে প্রাইভেট চিকিৎসার অস্বাভাবিক খরচ—দুটির ফাঁদেই আটকে আছে কক্সবাজারের দাঁতের রোগীরা।

শহরের সমিতি পাড়ার দিন মজুর লিয়াকত হোসেন জানান, ‘তিন বছর ধরে তার স্ত্রী রাবেয়ার দাঁতের সমস্যায় ভুগছিলেন। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দিন কাটছিল। প্রাইভেট চিকিৎসার উচ্চ খরচ বহন করতে না পেরে ভ্রাম্যমাণ এক ডাক্তারকে দেখান। সেখানে ভুল চিকিৎসায় দাঁতের অবস্থা ভয়াবহ হয়ে যায়। পরে ঋণ করে চট্টগ্রামে গিয়ে তিনটি দাঁত তুলতে হয়েছে।’

শহরের বাহার ছড়ার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে দাঁতের সমস্যা নিয়ে সদর হাসপাতালে যান। ওখানে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চট্টগ্রাম রেফার করেন। কিন্তু এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম যাওয়া কষ্টসাধ্য। তিনি বাধ্য হয়ে প্রাইভেটে এক চিকিৎসকের কাছে যান। যেখানে বাড়তি দামে চিকিৎসা করেন। তিনি মন্তব্য করেন এটা প্রাইভেটে রোগী পাঠানোর একটা কৌশল।’

শহরের পেশকার পাড়ার রোকসানা জানান, ‘কক্সবাজারে দন্ত চিকিৎসায় মারাত্মক অব্যবস্থাপনা। জেল হাজতে থাকা তার ভাইয়ের দাঁতে সামান্য সমস্যা থাকায় চট্টগ্রাম রেফার করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রচণ্ড ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।’

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের বির্হিবিভাগের দন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রের ডেন্টাল সার্জন ডা. বাবু চক্রবর্তী জানান, ‘দুই বছর যাবৎ এনজিও সার্পোট থাকায় ভালোভাবে চিকিৎসা সেবা চলছিল। যা এখন সম্ভব হচ্ছে না। তবে আগামী ৬ মাস পরে নতুন কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গেলে পুরোদমে কাজ চলবে। অনেক সময় কম দামে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের চট্টগ্রাম রেফার করা হলে তারা ওখানে না গিয়ে কুয়াক ডাক্তারের কাছে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

দন্ত চিকিৎসক ডা. মো. বশীর আহমেদ জানান, ‘সদর হাসপাতালে দৈনিক এক থেকে দেড়শ দাঁতের রোগী আসেন। লোকবল সংকট এবং পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ না থাকায় অনেক সময় জটিল চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এজন্য তাদের চট্টগ্রাম রেফার করা হচ্ছে। এছাড়া দাঁতের চিকিৎসা স্পর্শকাতর এবং সময়সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে চাইলেও এতো রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব না। অনেক সময় একেকটা রোগীর পিছনে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। টিম ওর্য়াকের কাজ ‘

ভুল চিকিৎসার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দন্ত চিকিৎসায় একই যন্ত্রাংশ একাধিকবার ব্যবহার করা উচিৎ নয়। নিম্নমানের মেডিসিন দিয়ে এই চিকিৎসা করা যাবে না। এতে করে সুস্থতার পরিবর্তে অসুস্থ হয়ে পড়বে।’

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক ডা. মংটিংক্রো জানান, ‘২৫০ শয্যার কক্সবাজার সদর হাসপাতালে দৈনিক ৮শ থেকে ১ হাজার পর্যন্ত রোগী আসে। তার মধ্যে দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসে এক থেকে দেড়’শ রোগী। এনজিও’র সার্পোট থাকাকালীন লোকবল সংকট না থাকায় যথাযথ সেবা প্রদান করা গেলেও এই সময়ে একটু বেগ পেতে হচ্ছে।’

কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদুল হক জানান, ‘দেশে দন্ত চিকিৎসার ডাক্তার সংকট। তার মধ্যে হাসপাতালে এতো মানুষের দন্ত চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পরিস্থিতি নেই। তাই অনেক সময় হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসবে সংস্কার আসবে।’

রোগীদের সচেতনতার অভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, চিকিৎসা স্বাস্থ্যে ‘এমবিবিএস আর বিডিএস’ ছাড়া বাকিরা ডাক্তার না। বিষয়টি সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। এছাড়া লোকজনকে সচেতন থাকতে হবে যেন মূল্যবান দাঁত নিয়ে অবহেলা না করে। অল্প টাকা বাঁচানোর জন্য যেন বড় ভুল না করে।

সারাবাংলা/এসএস

অব্যবস্থাপনা কক্সবাজার চিকিৎসা দন্ত প্রাইভেট ফাঁদ বাণিজ্য সরকারি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর