‘আমরা ধর্মীয় বিভাজন চাই না; আমরা চাই ঐক্য, চাই নৈকট্য। আমরা সংঘাত চাই না; আমরা চাই সংলাপ। আমাদের মধ্যে সংলাপ অপরিহার্য, স্থির থাকা অপরিহার্য। কেবল তখনই আমরা নতুন কিছু গড়তে পারব।’
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও সম্প্রীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এসব কথা বলেন।
কাথলিক চার্চের উদ্যোগে ‘সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তুলি’ শিরোনামে এ সম্মেলনের আয়োজন করে খ্রিষ্টীয় ঐক্য ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ কমিশন। সকাল ৯টায় শুরু হওয়া সম্মেলনে প্রায় ৯৫০ জন অংশ নেন, যাদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা।
সম্মেলনে কাথলিক চার্চকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘একসময় নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত হয়। এর মানে হলো রাষ্ট্র ধর্ম বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকবে, কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না। আবেগকে যুক্তির কাছে সঁপে দিতে হবে। আবেগ অযৌক্তিক হয়ে উঠলে তা ধ্বংস ডেকে আনে। এজন্য সংলাপ অপরিহার্য।’
ভ্যাটিকানের ডিকাস্টারি ফর ইন্টাররিলিজিয়াস ডায়ালগ-এর প্রিফেক্ট কার্ডিনাল জর্জ যাকোব কোভাকাদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাকে পরিচিত করিয়ে দেন আর্চবিশপ কেভিন রান্ডাল।
কার্ডিনাল কোভাকাদ বলেন, ‘সংলাপ মানে একে অপরের সঙ্গে সত্যিকারের বন্ধুর মতো দেখা করা সম্মান নিয়ে দেখা করা। এবং এটি এই বিশ্বাস যে, মানবজাতির মহৎ ধর্মীয় ঐতিহ্যে ঈশ্বর কাজ করছেন। এসব ঐতিহ্যকে আমাদের মর্যাদা দিতে হবে। অনেকে এখনও ধর্ম ও বিশ্বাসের বহুত্ববাদ মেনে নিতে কষ্ট পান। কিন্তু ভিন্নতাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আন্তঃধর্মীয় শিক্ষা কুসংস্কার ও প্রতিরোধ ভাঙতে পারে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় শিক্ষা ও জ্ঞানের বিকল্প নেই। আমাদের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আগামী প্রজন্মকে বহুত্ববাদকে মর্যাদা দিতে প্রস্তুত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে সংলাপ ও সহযোগিতা হতে হবে পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার পরিবেশে। সংলাপই পথ, সহযোগিতাই আচরণের নীতি, আর পারস্পরিক বোঝাপড়াই হলো পদ্ধতি ও মানদণ্ড।’
আর্চবিশপ কেভিন রান্ডাল সম্মেলনে পোপ লিও চতুর্দশের বার্তা পাঠ করেন। সেখানে বলা হয়, ‘সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ার মানে শুধু ধর্মীয় শিক্ষার আদান-প্রদান নয়, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা। ঈশ্বরের চোখে পবিত্র ধর্ম হলো এতিম-বিধবার পাশে দাঁড়ানো এবং নিজেকে পৃথিবীর অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, প্রকৃত আন্তঃধর্মীয় বন্ধুত্বের মাপকাঠি হলো সমাজের সবচেয়ে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুঃখজনক ঘটনায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একত্রে প্রার্থনা ও সংহতি প্রকাশ করেছে— যা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে কাথলিক চার্চের আন্তঃধর্মীয় উদ্যোগ তুলে ধরা হয় একটি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে। এরপর জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয় এবং অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। পরে পর্যায়ক্রমে পবিত্র কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করে আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করা হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্মীয় নেতারাও ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি বিষয়ে মত প্রকাশ করেন।
সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি।