চট্টগ্রাম ব্যুরো : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিজয়ীদের স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তবে ‘তলে-তলে’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে ছাত্রলীগের ভোট পাওয়ায় ছাত্রশিবিরের এ বিজয় সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রামে প্রয়াত বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের শোকসভায় তিনি এসব কথা বলেন। নগরীর পাঁচলাইশে একটি কমিউনিটি সেন্টারে এ শোকসভার আয়োজন করে ‘মরহুম আব্দুল্লাহ আল নোমান শোকসভা কমিটি- চট্টগ্রাম’। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘ডাকসু ইলেকশন হয়েছে। ইলেকশনে বিএনপি হেরে গেছে, এটা আপনারা বলতে পারেন। আমি কিন্তু বলতে পারি না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামীর এত ভোট কোত্থেকে আসল ? আমার তো হিসেবে মিলে না ভাই। আমি বলতে চাই না যে, কারচুপি করেছে। আমি বলতে চাই, দেশে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছি আমি।’
‘কারণ, আমরা যখন বিভিন্ন দল একসঙ্গে বসি, তখন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বারবার আমাদের কী বলে জানেন ? বলেন- ভাই, খেয়াল রাইখেন, আওয়ামী লীগ যাতে আর ক্ষমতায় আসতে না পারে, আওয়ামী লীগ ঠেকান সবসময়, আওয়ামী লীগ আসলে সবাইকে কচুকাটা করবে। এটা তাদের (জামায়াত) ডায়লগ। আমরা ঠিকভাবেই চললাম। আর তলে তলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে ছাত্রলীগের সকল ভোট জামায়াত নিয়ে নিল। বুঝতে পেরেছেন এখন ?’
ডাকসুর নির্বাচন থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ডাকসুর নির্বাচনে কিন্তু দুইটা কাজ হয়েছে- ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ২০০৮ সালের মতো, আবার ছাত্রলীগের ভোট। দেখেন, এরা (জামায়াতে ইসলামী) কত বড় মোনাফেকের দল একটু দেখেন, এদের কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে যেতে হয়েছিল, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে যেতে চাননি, জোর করে মুজাহিদ সাহেব, আল্লাহ তাকে বেহেশতে নসিব করুন, নির্বাচনে নিয়ে গেলেন। তার ফল কী হল ? জামায়াতে ইসলামীর চার থেকে পাঁচজন লোকের ফাঁসি হয়ে গেল। আর আমাদের ছেড়ে চলে গেল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।’
জেলখানায় মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে কথোপকথনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বহুদিন জেল খেটেছি। জেলখানায় একপর্যায়ে নিজামী, মুজাহিদ সাহেব, ডা. আবু তাহের, যাদের ফাঁসি হয়েছে, এরা কিন্তু সকলেই আমার সঙ্গে ছিলেন। জেলখানায় একসঙ্গেই ছিলাম। আমি একদিন নিজামী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, নিজামী সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, জামায়াতের মধ্যে বোধহয় আর নেতা আসবে না এমন, উনি একমাত্র লোক, সত্যিকার অর্থেই একজন জ্ঞানী লোক ছিলেন। উনাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর, আপনি নির্বাচনে কেন গেলেন বলেন তো ? নিজে তো গেলেন, আমাদেরও নিয়ে গেলেন, মারলেন তো আমাদেরও। উনি বললেন- আমি ভাই এ বিষয়ে কিছুই বলবো না।’
‘উনি (নিজামী) নীরব থাকলেন, পাশে ছিলেন মুজাহিদ সাহেব। উনার সঙ্গে আমার বয়সের তফাৎ ছিল না। আমি বললাম- মুজাহিদ সাহেব আপনি বলেন, কেন আমরা নির্বাচনে গেলাম ? উনি বললেন- আপনি বুঝবেন না কেন গেছি ? দুর্ভাগ্য এই, ওই নির্বাচন কিন্তু উনাদের ফাঁসির দড়িতে নিয়ে গেল।’
জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘প্রেমের সম্পর্ক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘চার থেকে পাঁচজনের ফাঁসি হল। তারপরও দেখেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের (জামায়াতে ইসলামী) প্রেম কিন্তু ছুটে না। এখনও আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে। এই নির্বাচনেও ভারতে বসে বসে তারা (আওয়ামী লীগ) ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে, জামায়াতকে ভোট দিতে হবে। অর্থাৎ বিএনপিকে ধ্বংস করলে আর কোনো সংশয় থাকে না জামায়াতে ইসলামের। আওয়ামী লীগ বাইরে থেকে জামায়াতকে দেখিয়ে বলবে, এই মৌলবাদীরা শক্তিশালী হচ্ছে, সুতরাং এই দেশটা দখল করতে হবে। এরকম চিন্তাভাবনা আওয়ামী লীগের ভেতরে আছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না দেশটা কোনদিকে যাচ্ছে।’
ডাকসুতে বিজয়ী শিবিরকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আরেকটি কথা আমি বলি, নির্বাচনে যা-ই হোক, যেভাবেই হোক, ওরা ইলেকশনে পাস করেছে। আমি তাদের আজকের সভা থেকে স্বাগত জানাতে চাই। আমি আশা করবো, এই কমিটি, ওরা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষার চেষ্টা করে। তাদের নেতারা ভুল পথে দেশটাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে, সেখান থেকে তারা যেন দেশটাকে রক্ষা করে। আমি তাদের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
পাঁচ আগস্টের পর বিএনপির কেউ কেউ লোভ সামাল দিতে পারেনি মন্তব্য করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আপনি বলতে পারেন, হ্যাঁ, পাঁচই আগস্টের পরে তো বিএনপির লোকেরা অনেক অত্যাচার করেছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু কথাটা সঠিক নয়। বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ মিশে অপকর্ম করছে। আবার জামাতের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ মিলে অপকর্ম করছে। আর সমস্ত দোষ বিএনপির ওপর আসছে। বিএনপির ছেলেরা, তারা কিছুই বোঝে না সেটা আমি বলবো না, তারা বোঝে, তারা এ লোভ সামাল দিতে পারেনি হয়তো-বা।’
‘আমি আজ বলে যেতে চাই, আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেব পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী, কোনো চাঁদাবাজ, কোনো দখলদারের জায়গা হবে না। এখনো যদি কেউ নিজেকে সামাল না দেন, এখনো যদি কেউ নিজেকে ঠিক না করেন, তাহলে যদি খবর আসে, ইনশল্লঅহ আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপি স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দল। মনে রাখতে হবে, বিএনপি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দল। মনে রাখতে হবে, এদেশে এখন বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের নেতা তারেক রহমান। সুতরাং এখানে চাঁদাবাজের কোনো জায়গা নেই। এখানে দখলদারের কোনো জায়গা নেই।’
তিনি বলেন, ‘মঞ্চে দাঁড়িয়ে কিন্তু আমাদের অনেক দখলদারেরাও বক্তৃতা দেয় যে, দখলদারি করা যাবে না। বুঝতে পেরেছেন আমাদের অবস্থাটা ? মঞ্চে দাঁড়িয়ে সকলেই চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে, দখলদারের বিরুদ্ধে কথা বলে আর বাইরে গিয়েই অপকর্মটা শুরু করে। এই ধরনের লোকগুলোকে কিন্তু আমরা চিনি, আমরা জানি। সাবধান হয়ে যাবেন, চাঁদাবাজের জায়গা বিএনপিতে নাই এবং যারা করতেছেন তারা বিএনপির লোক না। তারা যুক্ত হয়েছে আর বিএনপির নাম দেয়।’
বিএনপির বিরুদ্ধে দেশে এবং দেশের বাইরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটিমাত্র দল বাংলাদেশে, যে দলের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ, সার্বভৌমত্ব নিরাপদ, মানুষের জান-মাল নিরাপদ। আরেকটা বিষয় হল, আমাদের এই দেশটা বিএনপির নেতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীন করেছিলেন। এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন। আমি মনে করি, বিশ্বাস করি, আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, একমাত্র বিএনপির হাতেই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ, আর কেউ স্বাধীন রাখতে পারবে না।’
‘সুতরাং আমাদের ভুলত্রুটি যা-ই হয়েছে, সবকিছু সংশোধন করে, আসুন, সামনে আমাদের আরও কঠিন পরীক্ষা আছে। সেই পরীক্ষায় জয়লাভের জন্য যা করা দরকার, নিজেদের দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করি।’
প্রয়াত আবদুল্লাহ আল নোমানের স্মৃতিচারণ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘অসুস্থ শরীর নিয়েও নোমান ভাই হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে কখনো পিছপা হননি। আমরা গণঅভ্যুত্থান করে হাসিনাকে উৎখাত করেছি। আজ নোমান ভাই সঙ্গে থাকলে আমাদের আরও ভালো লাগতো। নোমান ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’
শোকসভায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, নগর কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর এবং প্রয়াত আবদুল্লাহ আল নোমানের সন্তান সাঈদ আল নোমান।