ঢাকা: অনলাইন জব পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা ভুয়া ওয়েবসাইটে এখন চাকরির অফার যেন হাতের মোয়া। ঘরে বসে মোবাইল বা ল্যাপটপ দিয়ে পার্টটাইম চাকরির চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে পা দিয়েই পড়ছে ভয়াবহ প্রতারণায়। বিশেষ করে তরুণ চাকরিপ্রার্থীদের লক্ষ্য করে প্রতারক চক্র নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে। অনেকেই না বুঝে প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে হারিয়ে ফেলছেন সর্বস্ব। তবে এক্ষেত্রে প্রতারকরা বিজ্ঞাপনে সরকারি ও পরিচিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার করে এবং মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ ও নগদ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেকারের সংখ্যা ২০২৩ সালে ২৫ লাখ ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ২৭ লাখে পৌঁছেছে। প্রতিবছর কমপক্ষে ২০-২২ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া আইডি বা পেজ খুলে পার্টটাইম চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। তাতে বলা হয়, দৈনিক দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করে মোবাইল বা ল্যাপটপ দিয়ে মাসে আয় করুন ২০-৩০ হাজার টাকা। এসব বিজ্ঞাপনে বিশ্বস্ততা অর্জনের চেষ্টায় সরকারি ও বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির লোগো ব্যবহার করে প্রতারকরা।
জানা গেছে, প্রথমে চাকরির বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলেই একটি হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর সেখানে প্রতারক নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। তার পর নাম ও বয়স জানতে চাওয়া হয়। পরে কাজে কমিশন কেমন পাওয়া যাবে জানিয়ে এ কাজে আগ্রহ আছে কিনা প্রতারকরা জানতে চায়। কাজ করতে রাজি হলে একটি লিঙ্ক দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার কথা বলা হয় এবং সেখানে রেজিস্ট্রেশন করলেই ১৫০-২০০ টাকা পাওয়া যাবে বলে জানায়। রেজিস্ট্রেশন করার পর স্ক্রিনশট দিলে দেওয়া হয় একটি টেলিগ্রাম আইডির লিঙ্ক। তখন বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করে পাওয়া টাকা বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তুলে নিতে বলা হয়। এর পরই মূল খেলা শুরু করে প্রতারকরা।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে পাওয়া টাকা তুলে নেওয়ার পর ৫০০ টাকা দিয়ে (কোনো চাকরির ক্ষেত্রে কমবেশি বলা হয়) কয়েকটি প্রোডাক্ট কিনলে ২০ মিনিটেই ১২০০ টাকা পওয়া যাবে বলে অফার দেওয়া হয়। এমনকি ২৫ হাজার টাকা আয় করারও অফার দেওয়া হয়। তখনই প্রোডাক্ট কেনার করার নামে বিভিন্ন টাস্ক পূরণ করতে বলা হয়। কিন্তু দেখা যায়, একটি টাস্ক পূরণ করার পর আরেকটি টাস্ক করতে ভালো অংকের টাকা ডিপোজিট করতে বলা হয়। অনেকেই আগের মতো ফের ডিপোজিট করতে থাকে। কারণ, তাদের মনে করে হয়- এবার ডিপোজিট করলে টাস্ক পূরণ হবে। কিন্ত ডিপোজিট করলেই নতুন টাস্কে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকে আবার সামনে বেশি টাকা লোকসান হতে পারে ভেবে এখানেই থেমে যায়। তবে যাকে তার হারানো টাকা পাওয়ার নেশায় ধরে, তিনি আরও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হন।
এদিকে, কোনো চাকরির লিঙ্কে প্রবেশ না করলেও হোয়াটসঅ্যাপেও একটি বাংলাদেশি নম্বর দিয়ে এসএমএস করে প্রতারক তার ভুয়া পরিচয় দেয়। তবে ওইসব নম্বরের অ্যাকাউন্টে বেশির ভাগই মেয়েদের নাম ব্যবহার করা হয়। আর এসব নম্বরে ফোন দিলে কল রিসিভ করা হয় না। এই প্রতারকরা হোয়াটসঅ্যাপ ভুক্তভোগীদের টেলিগ্রামে নিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে প্রতারিত করতে থাকে।
এমনই একজন প্রতারণার শিকার হয়েছেন ঢাকার আশুলিয়ায় বসবাসরত মেহেদী হাসান। তিনি পাক্সার বিডি লিমিটেডে চাকরি করেন। ঘরে বসে চাকরির নামে এবং অল্প পুঁজিতে অধিক লাভের ফাঁদে পড়ে দেড় লাখ টাকা খুইয়েছেন মেহেদী। এ ঘটনায় গত ৩০ আগস্ট আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন তিনি।
ভুক্তভোগী মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট ফারহান নামের একজন টেলিগ্রামে মেসেজ দিয়ে গুগল রিভিউ কাজের কথা বলে। পরে সে একটি লিংক দেয় এবং আইডি খুলে দেওয়ার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে ২০০০ টাকা দিতে বলে। আইডি খুলে দেওয়ার পর জগা ওয়ান নামে একটি টেলিগ্রাম আইডির লিংক দেয়। জগাওয়ান নামক ব্যক্তি আমাকে rents21.com নামক ওয়েবসাইটে কাজ করিয়ে এবং বেশি বেশি কমিশন দেখিয়ে ধাপে ধাপে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৮ টাকা (বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে) নিয়ে যায়। পরবর্তী ধাপে ওই টাকা ফেরত চাইলে আমার কাছে ৭২ হাজার টাকা দাবি করে। প্রতারণার শিকার হয়ে আমি আশলিয়া থানায় জিডি করেছি।’
সিলেটের মৌলভীবাজারের বাসিন্দা পিংকু নাথ সৌরভ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত জানুয়ারিতে অনলাইনে ঘরে বসে চাকরি এবং অধিক লাভের লোভ দেখিয়ে seeuw.com এই সাটের মাধ্যমে প্রতারক চক্র আমার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। থানায় কোনো অভিযোগ করিনি।’
রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বরে বসবাস করেন শামীম আহমেদ। তাকেও হোয়্যাটসঅ্যাপ থেকে টেলিগ্রামে এবং পরে walmart.com এ অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার পর কয়েক ধাপে তার থেকে ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অগ্রিম কোনো টাকা লাগবে না জানিয়ে আমাকে ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে ২০০ টাকা গিফট করে। পরে জানায় ৪০০ টাকা আমার অ্যাকাউন্টে বিকাশের মাধ্যমে জমা করলে ১২০০ টাকা পাব। আমি ওই ভাবেই টাকা পাই। এর পর আমাকে আরও অফার করে। কিন্তু এভাবে তাদের অফার নিতে গিয়ে দেখি আমার ১৫ হাজার টাকা তাদের কাছে। সেটা তোলার সুযোগ নাই। টাকা দিবে বলে আরও ব্যালেন্স জমা করতে বলে। তখন ভাবি, যা গেছে যাক, আর সামনে এগোবো না।’
এভাবে প্রতারিত হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা আইনি ব্যবস্থা নিলে টাকা উদ্ধার করা সম্ভব কি না? জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদি কেউ এরকম প্রতারিত হয়ে থাকে তবে সিআইডিকে জানাতে পারে। ভুক্তভোগীরা মামলা করার পর দ্রুত সিআইডিকে জানালে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব নিয়ে আমাদের সাইবার ইউনিট কাজ করে যাচ্ছে এবং প্রতারকদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে।’
প্রতারকরা মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ বা নগদ’র অ্যকাউন্ট খোলার সময় তাদের সব তথ্য তো চলে যাচ্ছে। কিন্তু, তারপরও তারা কেন এরকম কাজ করে থাকে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতারণা আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রতারকরা অন্যায় করতে করতে তাদের ভেতরে ধরা পরার চিন্তা সবসময় কাজ করে না। তবে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু দেখলেই সেখানে ক্লিক না করাই ভালো। এ ক্ষেত্রে তাদের ফ্যাক্টচেক করা দরকার। তারপর মোবাইলে অনেক সময় কোড আসে, সেগুলো কাউকে দেওয়া যাবে না।’
এ প্রসঙ্গে অপরাধ বিশষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের লোভকে আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখেই সেখানে প্রলোভিত না হওয়ার মনমানসিকতা থাকতে হবে। কিছু দেখলেই সেখানে ক্লিক না করে, সেটি যাচাই করা উচিত। প্রয়োজনে ভালো কারও পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। তা না হলে প্রতারিত হয়ে সর্বশান্ত হতে হবে। শেষ কথা হলো, লোভ নিয়ন্ত্রণ করে অল্প টাকায় বড়লোক হওয়ার চিন্তা পরিহার করতে হবে।’