রংপুর: তারাগঞ্জের ধুলোমাখা রাস্তায় এক ছোট্ট কিশোরের চোখে এখন আশার ঝিলিক। বড় হয়ে সে আইনজীবী হবে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মাত্র ১৪ বছরের জয় রবিদাস, যে কয়েক সপ্তাহ আগে বাবার ছায়া হারিয়ে স্কুলের বই ছেড়ে জুতা সেলাইয়ের সুই-সুতা তুলে নিয়েছিল, আজ ফের স্কুল ব্যাগ কাঁধে ক্লাসে ফিরেছে। তার চোখে এখনো বাবার স্মৃতি, কিন্তু হৃদয়ে জ্বলছে নতুন স্বপ্ন। এ যেন শুধু একটি ছেলের গল্প নয়, একটি মানবতার জয়ের গল্প। যেখানে সমাজের সহমর্মিতা ভাঙা হৃদয়কে জোড়া লাগিয়েছে।
গত ৯ আগস্টের সেই কালো রাতটি জয়ের জীবনকে চিরতরে পালটে দিয়েছে। তার বাবা রূপলাল রবিদাস এবং ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাস ভ্যানে বাড়ি ফিরছিলেন। তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলায় স্থানীয়রা তাদের চোর সন্দেহে আটক করে। সন্দেহ থেকে উত্তেজনা, তারপর মব—লাঠি, লোহার রডের আঘাতে দুজনের প্রাণ যায়। রূপলালকে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মৃত ঘোষণা করা হয়, প্রদীপ পরদিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই নির্মমতা শুধু দু’টি প্রাণ কেড়ে নেয়নি, একটি পরিবারের স্বপ্নও ছিন্নভিন্ন করেছে।
রূপলাল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তারাগঞ্জ বাজারের ফুটপাতে তিনযুগেরও বেশি সময় ধরে জুতা সেলাই করে তিনি সংসার চালাতেন। স্বপ্ন দেখতেন ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করার। বাবাকে হারিয়ে জয় দিশেহারা। স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র সে, কিন্তু সংসারের ভার কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয় ফুটপাতের সেই চৌকিতে বসতে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জুতা সেলাই করে ২৮০-৩০০ টাকা আয় করত সে।
জয় বলেন, ‘বাবা কত কষ্ট করতেন, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে কোমর লেগে যায়, পা অবশ হয়ে আসে। বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে শিক্ষক হিসেবে দেখার। কিন্তু উপায় নেই। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে বাবার পেশায় নেমেছিলাম। কারণ, মা, ঠাকুরমা, দুই বোন— সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। আমার পড়াশোনা কতদূর হবে জানি না, কিন্তু বোনদের পড়াতে চাই।’
কিন্তু অন্ধকারের মাঝে আলো এসেছে মানুষের সহমর্মিতায়। সম্প্রতি জয়ের সংগ্রাম জানতে পেরে স্থানীয় প্রশাসন, বিএনপি-জামায়াতসহ অনেকে পাশে দাঁড়ায়। এছাড়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা এক লাখ টাকা সহায়তা দেন। তিনি জানিয়েছেন জয়ের এইচএসসি পাশ করা বোন বড় বোন নুপুর রানীর চাকরি এবং জয়ের জন্য দোকানঘরের প্রক্রিয়া চলছে।
ইউএনও রুবেল রানা বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেয়েছে পরিবারটি। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা যাতে ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।’
জয়ের মা ভারতী রানী বলেন, ‘ছেলেটাকে স্কুলে পাঠাতে না পেরে বুক ফেটে যাচ্ছিল। বাবা বেঁচে থাকলে ছোট জয়কে ফুটপাতে কাজ করতে হতো না।’ জয়ের ঠাকুরমা (দাদি) লালিচা রানী বলেন, ‘নাতি-নাতনিরা এতিম হয়ে গেল। ওরা কান্নাকাটি করে, রাতে ঘুমায় না।’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু মুসা বলেন, ‘জয় মেধাবী ছাত্র। বাবাকে হারানোর পর স্কুলে আসা বন্ধ করেছিল। কিন্তু এখন সে আবার ফিরেছে, ওকে দেখে ভালো লাগছে। তাকে মানসিকসহ সবধরনের সহায়তা দিচ্ছি। গত রোববার থেকে জয় নিয়মিত ক্লাস করছে।’
জয় বলেন, ‘আমি নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। শিক্ষক-সহপাঠী সবাই উৎসাহ দিচ্ছে। এখন আর জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হয় না। বাবার স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখা করে আইনজীবী হতে চাই। যেদিন বাবার আসনে বসে কাজ করার সময় বুক ফেঁটে কান্না এসেছিল। কিন্তু কাঁদতে পারিনি। বাবাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলায় আমরা এতিম হয়ে গেছি।’
ঘটনার আদ্যপান্ত
পুলিশ, নিহতদের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ঘটনাস্থল সম্পর্কে অবগত— এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর দাসের জন্য বিয়ের আলোচনা হচ্ছিল মিঠাপুকুর উপজেলার এক পরিবারের সঙ্গে। ১০ আগস্ট রোববার এ বিষয়ে দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার কথা। এ নিয়ে কথা বলার জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান নিয়ে কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুরে রূপলাল দাসের বাড়িতে আসছিলেন ভাগ্নি জামাই প্রদীপ দাস। কিন্তু তারাগঞ্জ উপজেলা সয়ার ইউনিয়নে এসে কুর্শা যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে তিনি রূপলাল দাসকে ফোন দেন।
রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর দাস জানান, আমার মামাতো বোন জামাইবাবুকে (প্রদীপ দাস রূপলাল দাসের ভাগ্মী জামাতা) আনতে বাবা বের হয়ে যান। জামাইবাবুর ভ্যানেই তারা বাড়ির দিকে আসছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্যান কাজীরহাট সড়কের বটতলা নামক একটি জায়গায় এলে কয়েকজন থামান। এর পরই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে, যাতে দুজনই গুরুতর আহত হয়ে মারা যান।
তিনি বলেন, “প্রথমে জমায়েত হওয়া ব্যক্তিরা আমার বাবা রূপলাল দাস ও বোন জামাই প্রদীপ দাসকে ‘ভ্যান চোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। বাবা এ সময় তাদের বিষয়ে জানার জন্য বারবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বা মেম্বারকে ফোন দিতে বলেন। কিন্তু, জমায়েত ব্যক্তিরা কোনো তোয়াক্কা করেননি। আমার বাবা হাত জোর করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন। কিন্তু, নিষ্ঠুর, নির্দয় মনের মানুষেরা শোনেননি। তিনি বার বার বলছিলেন আমি চোর না, আমি ডাকাত না। আমি জুতা সেলাই করি। কিন্তু, কেউ শোনেননি।’
স্থানীয় এক ব্যক্তি সারাবাংলাকে জানান, এর মধ্যেই আরও লোকজন জমায়েত হয়ে তাদের গণপিটুনি দিতে শুরু করে এবং মারতে মারতেই বুড়িরহাট স্কুলের মাঠে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা জ্ঞান হারালে হামলাকারীরা চলে যায়। এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রূপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। আর রোববার সকালে মারা যায় প্রদীপ দাস। তাদের মৃত্যুর খবরে কুর্শা ইউনিয়নের লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
কেন এই পরিস্থিতি?
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র বলেছে, উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পাড়ায় ঘন ঘন চুরি ডাকাতির ঘটনা ঘটছিল। এমনকি একজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা ভ্যান নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন স্থানীয় লোকজন। সেদিন রাতে রূপলাল ও প্রদীপ দাসের ভ্যান বটতলা এলাকায় আসার পর কয়েকজন লোক ভ্যান ঘিরে ধরে। তারা ওই ভ্যানে রাখা একটি বস্তা থেকে কয়েকটি বোতল বের করেন এবং এসব বোতলে চোলাই মদ রাখার অভিযোগ করেন।
জানা গেছে, দলিত সম্প্রদায়ের অনেকে নিজেদের ঘরে তৈরি চোলাই মদ সেবন করে থাকেন। এটি এই সম্প্রদায়ের অনেকে স্বাভাবিক জীবনাচরণের অংশ বলেও মনে করে থাকেন। ভ্যানের বোতলে থাকা তরল পদার্থের ঘ্রাণ নিয়ে কয়েকজন তাৎক্ষণিক অসুস্থ বোধ করার দাবি করলে উপস্থিত অন্যরা আরও মারমুখী হয়ে ওঠে।
তবে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, রূপলাল ও প্রদীপ দাসের ভ্যান বটতলায় পৌঁছার আগেই সেই ভ্যানে তিন জন নারী ছিলেন। বটতলায় আসার পর তিন নারী ভ্যান থেকে নেমে যান। এর পর তারা স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার পর লোকজন ভ্যানটি ঘিরে ধরে ‘ভ্যান চুরি’ ও ভ্যানে চোলাই মদ রাখার অভিযোগ করে মারতে শুরু করেন।
নিহত রূপলালের ছেলে জয় দাসের অভিযোগ, উৎসবে তারা বাংলা মদ খান। শ্যালিকার বিয়ে উপলক্ষে প্রদীপ লাল ছোট বোতলে করে সেগুলো নিয়ে আসছিলেন। বটতলায় তার বাবা ও বোন জামাইকে আল-আমিন, এবাদতসহ কয়েকজন আটক করে সেই বোতলগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে পথচারীরা জড়ো হন।
তিনি বলেন, ‘লোকজন জড়ো হলে তারা বাবা আর বোন জামাইকে চোর বলে। এর পর লোকজন মারধর শুরু করে। পাশের ফরিদাবাদ গ্রামের মেহেদী হাসান বস্তা থেকে বোতল বের করে কাগ না খুলেই নাকে নিয়ে অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করেন। এরপর উত্তেজিত লোকজন বাবা-বোনজামাইকে মারধর করে মেরে ফেলে।’
নিহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে প্রশ্ন
এ ঘটনায় নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী তারাগঞ্জ থানায় ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক উপপরিদর্শক (এসআই) ও ছয় কনস্টেবলকে (সদস্য) তারাগঞ্জ থানা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তবে মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিহত রুপলাল দাসের স্ত্রী মালতী ওরফে ভারতী রানীকে বাদী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তিনি দাবি করেছেন যে, পুলিশই এজাহার তৈরি করে তার স্বাক্ষর নিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না।
নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশ ঘটনাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে এবং নিজেদের দায় এড়াতে এজাহারে বিকৃতভাবে তথ্য উপস্থাপন করেছে। এজাহারে ভারতী রানীর নামে যে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে, তা তার নয়। বরং, টাঙ্গাইলের এক ব্যক্তির বলে নিশ্চিত হয়েছে পরিবার। এছাড়া, এজাহারে ৫০০-৭০০ অজ্ঞাত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হলেও, বাদী এ ধরনের কোনো তথ্য দেননি।
তারাগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ‘ঘটনাস্থলে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন। এর বিপরীতে সেখানে চার পুলিশ সদস্য ছিলেন। তারা তাদের (রূপলাল ও প্রদীপ) বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পেছন থেকে যখন পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি, ঘুষাঘুষি শুরু হয় তখন তারা জীবনের ভয়ে সরে এসেছেন। পুলিশের করার কিছু ছিল না। ভিডিও ফুটেজ দেখে ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকিরা এখনো পলাতক। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।