রংপুর: রংপুর, একসময়ের শান্ত এই উত্তরাঞ্চলীয় শহর এখন যেন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের নিরাপদ আখড়া হয়ে উঠেছে। গত ছয় মাসে পুলিশের হাতে কমপক্ষে ২০টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, আর সেপ্টেম্বর মাসের মাত্র ১০ দিনে উদ্ধারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪টিতে। নগরবাসীর মনে এখন একটাই আশঙ্কা; জুলাই বিপ্লবে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো যেহেতু এখনও পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি সেহেতু এই অস্ত্রগুলো কখন যে অপরাধের হাতিয়ার হয়ে উঠবে, তা কেউ জানে না।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কাল ভোররাতে নগরীর দর্শনা শুঁটকির আড়তসংলগ্ন এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১০টি একনলা বন্দুক এবং ৩৬ রাউন্ড রাবার কার্তুজ উদ্ধার হয়েছে, যা এই আশঙ্কাকে আরও গভীর করেছে।
পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চালানো এই অভিযানে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর যৌথ দল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে নগরীর তাজহাট থানাধীন দর্শনা মোড়সংলগ্ন শুঁটকি আড়ত এলাকায় সীমানাপ্রাচীর ঘেরা একটি বাগানে পরিত্যক্ত দুটি সাদা প্লাস্টিকের বস্তা জব্দ করে। বস্তার মুখ খুলতেই বেরিয়ে পড়ে এই ভয়াবহ অস্ত্রশস্ত্র। পরে এগুলো তাজহাট থানায় হস্তান্তর করা হয়।
নগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার মারুফ আহমেদ জানান, এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। অস্ত্রগুলো কোথা থেকে এসেছে এবং কারা এখানে ফেলে রেখে গেছে—তা উদঘাটনে তদন্ত চলছে।
কিন্তু এই তদন্তের ফলাফল না আসা পর্যন্ত নগরবাসীর মনে শান্তি ফিরবে কি এমন প্রশ্ন জেঁকে বসেছে বাসিন্দাদের মধ্যে।
এর আগে, গত ১ সেপ্টেম্বর মেট্রোপলিটন হারাগাছ থানা এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় চারটি বন্দুক উদ্ধার হয়, যা স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জুলাই মাসে তো আরও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে; গত ১৮ জুলাই রংপুরে তিনটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ দুই ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষীকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি দোনলা এবং দুটি একনলা বন্দুক, তিনটি ভুয়া লাইসেন্স এবং ১৫ রাউন্ড গুলি। এই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অস্ত্র আইনে তিনটি মামলা হয়েছে, এবং গ্রেফতারদের জেলহাজতে পাঠানো হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে গঙ্গাচড়ায় যৌথ অভিযানে কবরস্থান থেকে দুটি পিস্তল উদ্ধার হয়, যা এই অঞ্চলে অস্ত্রের ছড়াছড়ির আরেক প্রমাণ। বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়, জুলাই বিপ্লবে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো এখনও পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি, এবং এগুলো অপরাধীদের হাতে পড়ে অবৈধ ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।
সচেতন মহল সন্দেহ করছেন, অনেক অস্ত্র অপরাধীদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে, যা আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি।
অপরাধ বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহামুদুল হক প্রশ্ন রেখে বলেন, এই অস্ত্রগুলো কোথা থেকে আসছে? কারা এগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে? যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকলেও, অস্ত্রের উৎস উদঘাটন না হলে এই আতঙ্ক কমবে না। শহরের মানুষ চায় নিরাপত্তা, চায় শান্তি; কিন্তু অবৈধ অস্ত্রের ছায়া যেন তাদের দৈনন্দিন জীবনকে গ্রাস করছে। পুলিশের তদন্ত কতদূর এগোবে, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে সকলে।
রংপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর অর্থাৎ ১৯৭১ সাল থেকে রংপুর জেলায় বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ৪০৮টি। এরমধ্যে অনলাইনে নিবন্ধন আছে ৩৮৭টি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে মাঠে নামে এ যৌথ অভিযানে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বে ছিলেন। ৪ সেপ্টেম্বর রংপুরে বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত ৬০টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়ে। এসব অস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতা ও বিশেষ ব্যক্তিদের কাছে ছিল। তারা বিভিন্ন সময়ে এসব অস্ত্র আইনি এবং বেআইনি দুইভাবে ব্যবহার করেছেন। বাকি জমা না দেওয়া অস্ত্রগুলো অবৈধ হয়ে গেছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক লোকজনকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। ওই সময়ে যাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তাদের ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে বলা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে যারা নির্বিচারে গুলি করে গা-ঢাকা দিয়েছেন তাদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিলে অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার অভিযান শুরুর খবরে অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন।
রংপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জমা না দেওয়া বাকি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে শীঘ্রই অভিযান শুরু করা হবে। তবে সম্প্রতি ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (স্টাফ কর্নেল) কর্নেল শফিকুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৮০ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্র আসন্ন নির্বাচনের আগে জব্দ করা হবে। যাতে আগামী নির্বাচনে এসব অস্ত্র দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারে অপরাধী চক্রগুলো। সেনা কর্মকর্তার এমন আশ্বাসে অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে বাকী অস্ত্র উদ্ধারের দাবি উঠেছে নগরবাসীর পক্ষ থেকে।