কুমিল্লা : এক সময়ের প্রাণের উৎস— কুমিল্লার ঐতিহাসিক ‘রিজার্ভ ট্যাঙ্ক’ পুকুরটি এখন এখন বর্জ্যের স্তূপে পরিণত হয়েছে। দখল, দূষণ আর অবহেলায় এর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। পুকুরটি স্থানীয়দের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গিই ছিল না, বরং জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের পানির উৎস হিসেবেও কাজ করতো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এটি এখন সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, স্থানীয়রা পুকুরটির হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে দাবি জানিয়েছেন।
কুমিল্লা মহানগরীর বাগিচাগাঁও এলাকার সুপরিচিত ‘রিজার্ভ ট্যাঙ্ক’ পুকুরটি বর্তমানে চরম অবহেলা ও দুরাবস্থার শিকার। ঐতিহ্যবাহী এ পুকুর দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে তার জৌলুস হারাচ্ছে। এর চারপাশে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। এতে এটি সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এদিকে, কিছু অসাধু ব্যক্তি পুকুরের অংশবিশেষ দখল করে ভরাট করে ফেলছেন।
কুমিল্লার হাতেগোনা কয়েকটি ঐতিহাসিক পুকুর বা দিঘীর পাশাপাশি, এই ‘রিজার্ভ ট্যাঙ্ক’ নগরবাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায়, এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।
কুমিল্লা মহানগরীর পশ্চিমাংশে, বাগিচাগাঁও এলাকায় পুলিশ লাইন রেসকোর্স সড়কের পুলিশ লাইনস স্কুলের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক ‘রিজার্ভ ট্যাঙ্ক’ পুকুরটি। এর আয়তন প্রায় দুই একর। একসময় এটি কেবল একটি পুকুর ছিল না, বরং শত শত মানুষের গোসল, কাপড় ধোয়া ও অন্যান্য গৃহস্থালি কাজের জন্য এটি ছিল পানির এক প্রধান উৎস।
পুকুরটি পূর্ব ও দক্ষিণ দিক ব্যক্তি মালিকানাধীন ঘরবাড়ি দিয়ে ঘেরা থাকলেও, একসময় এর উত্তর ও পশ্চিম দিক সম্পূর্ণ খোলা ছিল। এই খোলা অংশ পুকুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ব্যবহার উপযোগিতা বাড়িয়ে তুলত। এই পুকুরটি কেবল একটি জলাশয় নয়, বরং এটি এই এলাকার মানুষের স্মৃতি আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
একসময় পশ্চিম পাশে ছিল একটি পাকা ঘাট। প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শত শত মানুষ এই ঘাট ব্যবহার করে পুকুরের পানি ব্যবহার করত। গোসল করা, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানা কাজে এই পুকুরটি ছিল এলাকার মানুষের একমাত্র ভরসা।
২০০১ সালে পুকুরটির পশ্চিম পাশে একটি বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত হয়। এখন চারপাশ বাসা-বাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ঘিরে পেলেছে। এর ফলে ধীরে ধীরে পুকুরটি চোখের আড়াল হয়। পুকুরে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে শুরু করে। বর্তমানে পুকুরের উত্তর কোণে আবর্জনার স্তূপ তৈরি হয়েছে, যা এর পরিবেশ ও সৌন্দর্যকে মারাত্মকভাবে নষ্ট করছে।
বছরের পর বছর ধরে ময়লা-আবর্জনা এবং কচুরিপানা পচে-গলে পুকুরটির তলদেশ প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এর পানি এখন এতটাই দূষিত যে তা কোনোভাবেই ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। একসময়ের প্রাণের উৎস এই পুকুরের পানি এখন আর কেউ ভুলেও ব্যবহার করে না।
জানা গেছে, একসময় কুমিল্লা শহর বা এর আশেপাশে কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাড়িগুলো এই পুকুর থেকেই পানি সংগ্রহ করতো। কিন্তু বর্তমানে পুকুরটির এমন বেহাল দশা যে জরুরি প্রয়োজনেও এটি কোনো কাজে আসে না।
কুমিল্লা নগরীতে তীব্র পানির সংকট থাকা সত্ত্বেও জেলা পরিষদের অধীনে থাকা পুকুরটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। যে কারণে আপৎকালীন সময়ে ফায়ার সার্ভিসের মতো জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানও স্বাভাবিক পানি উৎস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
স্থানীয়রা এই পুকুরটি দ্রুত সংস্কার করে এর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার এবং সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জোর দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, ‘আজ থেকে প্রায় ২০ থেকে ২২ বছর আগেও এই পুকুরের পানি এতটাই স্বচ্ছ আর ছিল। স্থানীয়রা ছাড়াও শহরের অন্যান্য এলাকার মানুষও এখানে গোসল করতেন ও সাঁতার কাটতে আসতেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই পুকুরটি দ্রুত সংস্কার করা হোক, যাতে এর হারানো ঐতিহ্য ও স্বাভাবিকতা আবার ফিরে আসে।’
ওই এলাকার জাকির হোসেন কাজল আক্ষেপ করে বলেন, পুকুরটি এখন দেখলে মনে হয় এটি কোনো পুকুর নয়, যেন ময়লার ভাগাড়। যেখানে ময়লা ছাড়া পানি নেই বললেই চলে।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরী জানান, ‘রিজার্ভ ট্যাঙ্ক’ নামের এই পুকুরটি সংস্কারের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ‘মেসার্স মুন্না এন্টারপ্রাইজ’ নামক প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। দ্রুত পুকুরটি সংস্কার হয়ে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।’