Saturday 13 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দাপুটে অবস্থানও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে
৫ বছরে ইউরোপে পোশাক রফতানি বেড়েছে ৫০ শতাংশ

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:০৬ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১১:১৭

ইউরোপে পোশাক রফতানি। ফাইল ছবি

ঢাকা: ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ঈর্শ্বনীয় সাফল্য দেখাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে ইউরোপের বাজারে দেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। আর এক দশকে বেড়েছে ৫৮ শতাংশেরও বেশি। চলতি বছরেও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাক রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গতবছরের প্রথম ৬ মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ইইউতে পোশাক রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। ইউরোপীয় কমিশনের সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, ইউরোপের বাজারে দেশের পোশাক রফতানি দাপুটে অবস্থানে থাকলেও বিষয়টি উদ্বেগেরও বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। পোশাক রফতানির প্রধান দুই গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নির্ভরতা কমাতে জোর প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রফতানি বাড়াতে পোশাক মালিক ও সরকারের পক্ষ থেকেও চেষ্টা চলছে। তবে সেভাবে ফল আসছে না।

বিজ্ঞাপন

ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি পরিমাণ ১২ হাজার ৩২২ মিলিয়ন বা ১২ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ইউরো। ২১ সালে ১৪ দশমিক ২৯ বিলিয়ন, ২২ সালে ২১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন, ২৩ সালে ১৭ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ও ২০২৪ সালে ১৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ইউরোর পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ইউরোপে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৪৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

তথ্যমতে, সারা বিশ্ব থেকে ২০২০ সালে ইউরোপ যেখানে ৬৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ইউরোর পোশাক আমদানি করে, সেখানে ২০২৪ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ইউরো। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ইউরোপের পোশাক আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ২৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের পোশাক রফতানি যেখানে ২০ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ইউরো ছিল, ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়ায় ২৪ বিলিয়ন ইউরো, যদিও ২০২২ সালে তা ২৮ বিলিয়ন ইউরো উঠেছিল। আর পাঁচ বছর ব্যবধানে চীনের পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্ধী ভিয়েতনাম ২০২০ সালে ইউরোপে পোশাক রফতানি করে ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ইউরো, সেখানে ২০২৪ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরো। পোশাক রফতানিতে দেশটির প্রবৃদ্ধি হয় ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। পাঁচ বছর ব্যবধানে অন্যান্য দেশের প্রবৃদ্ধি- তুর্ক ১৫ দশমিক ৯৪, ভারত ৪১ দশমিক ৭৭, কম্বোডিয়া ৫৯ দশমিক ৭৭, পাকিস্তান ৬৫, মরোক্কো ৩৭ দশমিক ৭০, শ্রীলঙ্কা ২২ দশমিক ৮১ ও ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ২২ শতাংশ।

এদিকে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) ইউরোপে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে যেখানে রফতানি ছিল ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের একই সমেয় তা বেড়ে ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এখানে প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর এই প্রথম ছয় মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপের পোশাক আমদানি বেড়েছে ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ।

জানতে চাইলে দেশের পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘পোশাকের ব্যবসা চীনের কাছ থেকে অন্য দেশগুলোতে স্থানান্তর হচ্ছে। বরং পুরো বিশ্বের পোশাক আমদানি আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। পোশাকের চাহিদা কিন্তু সেভাবে বাড়ছে না। চীনের রফতানি কমছে; সেটি ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে স্থানান্তর হচ্ছে এবং এসব দেশগুলোর রফতানি বাড়ছে। এটি ইউরোপে পোশাক রফতানি বৃদ্ধির মূল কারণ। এর বাইরে আমাদের সক্ষমতাও দিন দিন বাড়ছে। ফলে রফতানি বেড়েছে।’

পোশাক রফতানিতে অধিক মাত্রায় ইউরোপ নির্ভরতার বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘ইউরোপের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখি না। পোশাক রফতানির একক গন্তব্যে নির্ভরতা আমাদের কমাতে হবে। পাঁচ থেকে ১০ বছর আগে আমরা যে নতুন নতুন মার্কেটে যাত্রা শুরু করেছিলাম- জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, সাউথ আফ্রিকা; এসব যায়গায় রফতানি বাড়ছে। কিন্তু এসব দেশে রফতানি আরও বাড়াতে হবে। এককভাবে ইউরোপে বাড়ানো বা নির্ভরশীলতা- এটি বিপদজনক। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক যে বাস্তবতা ও ক্রয় ক্ষমতা; সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা, তাদের ক্রয় ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাপান একটি ভালো বাজার, তবে ভৌগলিক কারণে ভিয়েতনাম ও চীনের কাছ থেকে বেশি পোশাক কিনে থাকে। লিড টাইম কম হওয়ায় এসব দেশের প্রতি জাপানের আগ্রহ বেশি। এখন আমাদের ব্রাজিলের দিকে নজর দিতে হবে। আর বৈশ্বিক রাজনৈতিক কারণে রাশিয়ার সঙ্গে খুব বেশি এগুনো যাচ্ছে। তবে রাশিয়া একটি বড় মার্কেট। উচ্চমাত্রার ট্যারিফের কারণে তুর্কিতেও রফতানি বাড়ানো যাচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি। অন্য দেশগুলোতে পোশাক রফতানি বাড়াতে চেষ্টা চলছে, এই চেষ্টা চলমান রাখতে হবে।’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউরোপের পোশাক আমদানি কিন্তু সেভাবে বাড়েনি। তবে চীনের রফতানি কমায় বাংলাদেশ সেই গ্যাপের কিছু অংশ দখল করেছে। চীনের মার্কেট শেয়ার বাংলাদেশ পাচ্ছে। আর বাংলাদেশের পোশাকের দাম এখনো তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে আগে যেভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এখন কিন্তু সেভাবে হচ্ছে না। আবার ইউরোপের ভেতরে ফ্রান্স ও ইতালি পোশাক রফতানি করতো। তাদের পোশাক রফতানিও কমেছে। বাংলাদেশের পাশ্বর্বর্তী দেশ মিয়ানমারের পোশাক রফতানিও কমেছে। তুলনামূলক দাম কম থাকায় এসব শেয়ার বাংলাদেশ ধরতে পেরেছে।’

বিজিএমইএ’র সাবেক এই সভাপতি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনও বেসিক ছয়টি পণ্য রফতানি করছে। কিন্তু এর বাইরেও তো অনেক পণ্য রয়েছে। হাই ভ্যালু সেসব পণ্যের দিকে এগুতে পারছে না বাংলাদেশ। এ কারণে ভবিষ্যতে খুব বেশি রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। গেল কয়েক বছরে যেমন বেড়েছ, সেভাবেও নতুন করে বাড়বে না রফতানি।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘সামনে এলডিসি গ্র্যাডুয়েশন। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে বাংলাদেশের রফতানি কমেবে। আমরা জিএসপি প্লাস পাব না। আবার আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম শূন্য শুল্ক সুবিধা পাবে। তখন ইউরোপে আমাদের রফতানি কমবে।’

এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০২০ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে, অর্থাৎ এই পাঁচ বছরে ইউরোপে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। এটি যেমন ভালো, তেমনি শঙ্কারও। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র পালটা শুল্কারোপ করলে দেশটিতে পোশাক রফতানি নিয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপক উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির প্রায় ৫০ শতাংশ ইউরোপেই হয়ে থাকে। ফলে এককভাবে ইউরোপ নির্ভরতাও শঙ্কার। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ রফতানি হয়ে থাকে। দেশের পোশাক রফতানির প্রায় ৭০ শতাংশই রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে।’ যেসব দেশে ৩০ শতাংশ রফতানি হয় ও যেগুলোতে একেবারেই হয় না, বাংলাদেশের এখন সেসব দেশের দিকেও মনযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

ইউরোপ উদ্বেগ পোশাক রফতানি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর