চট্টগ্রাম ব্যুরো: ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনের সাফল্যে উজ্জীবিত ইসলামী ছাত্রশিবির এবার কোমর বেঁধে নামছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (চাকসু) জয়ের জন্য। ৪৫ বছর পর আরেকবার চাকসুতে পূর্ণ প্যানেলে জয়ের আশা করছে সংগঠনটি। অন্যদিকে ডাকসু নির্বাচনে পরাজয় ও জাকসু নির্বাচন বর্জনের পর চাকসু নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন ছাত্রদল নেতারা। তাদের মত হচ্ছে, প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না করলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অর্থহীন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৮টি পদের মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) ২৩টি পদে জয় পায় ছাত্রশিবির। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম কোনো নির্বাচনে বিশাল এ বিজয় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার চিত্র দৃশ্যমান হয়েছে।
এর পর গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (জাকসু) নির্বাচন হয়। দু’দিন পর ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, ছাত্রশিবির সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) ১৯টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ১৫টিতে জয় পেয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির আগে কখনো কোনো নির্বাচনে জয়ের মুখ দেখেনি। প্রথমবারের মতো এ সাফল্য ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের মনোবল আরও অটুট করেছে, এমনটাই বলছেন সংগঠনটির নেতারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডাকসুতে ইসলামী ছাত্রশিবির বিশাল জয় পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরেও আমাদের অধিকাংশ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর আস্থা রাখছেন। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমাদের নেতাকর্মীরা উজ্জীবীত হচ্ছেন, খুবই স্বাভাবিক।’
এদিকে গত ২৮ আগস্ট চাকসু নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ১২ অক্টোবর ভোটগ্রহণ হবে। এর আগে, মনোনয়নপত্র বিতরণ করা শুরু হবে আগামীকাল রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) থেকে। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে মনোনয়ন জমা নেওয়া শুরু হবে। ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র নেওয়া যাবে। এই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর।
মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শুরু হবে ১৮ সেপ্টেম্বর। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হবে। এটি প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হবে ২৫ সেপ্টেম্বর। এরপর ১২ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হবে।
এরই মধ্যে খসড়া আচরণবিধি ও খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে চাকসু নির্বাচন কমিশন। খসড়া তালিকা অনুযায়ী মোট ভোটার ২৫ হাজার ৭৫২ জন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) আচরণবিধি নিয়ে মতবিনিময় সভায় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সভা বর্জন করে বেরিয়ে যান ছাত্রদলের নেতারা। এর পর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
ফেসবুকের পোস্টে আব্দুল্লাহ আল নোমান লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দলকানা প্রশাসনের অধীনে কতটুকু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে আমরা যথেষ্ট সন্দিহান। এই দলকানা প্রশাসনের অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব কিনা তা এখন ভেবে দেখার বিষয়।’
জানতে চাইলে চবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচন করতে চাই। কিন্তু আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন একপেশে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাদের দলকানা মনোভাব এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়েছে। আমাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচনের সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সংস্কার করতে হবে। আমাদের আপত্তির জায়গাগুলো শুনতে হবে। অন্যথায় আমরা নির্বাচনে যাব কিনা, সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।’
চাকসু নির্বাচন কমিশন নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ছাত্রশিবিরও। তবে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে জয়ের পর তাদের আপত্তি আর জোরালো অবস্থায় নেই বলে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
চবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছি। এর মধ্যে গ্রামবাসীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। সেজন্য আমাদের প্রস্তুতি কিছুটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার কার্যক্রম জোরালো করেছি। আমাদের প্রার্থীদের রেডি করছি। তবে কৌশলগত কারণে আমরা কারও নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।’
ডাকসু-জাকসু’র মতো সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাকসুতেও শিবিরের ওপর আস্থা রাখবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে গত একবছর ধরে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব অনেক কার্যক্রম করেছি। এতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ৪৫ বছর আগে ১৯৮১ সালে শিবির একবার চাকসুতে পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়েছিল। এবারও আমরা আরেকবার সেই বিজয় দেখব বলে আশাবাদী।’
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর মোট ছয়টি চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭০ সালে চাকসুর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৯, ১৯৮১ সালে এবং ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ চাকসুর নির্বাচন হয়।
১৯৮১ সালে ভিপি পদে জসীম উদ্দিন সরকার ও জিএস পদে আব্দুল গাফফারসহ ছাত্রশিবিরের পূর্ণ প্যানেল জয়ী হয়। এরপর ১৯৯০ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা নাজিম উদ্দিন (ভিপি), আজিম উদ্দিন (জিএস) ও ছাত্রদলের মাহবুবের রহমান শামীম (এজিএস) নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা ফারুকুজ্জামান নিহত হলে চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গত ৩৫ বছরে আর চাকসুতে নির্বাচন হয়নি।