রংপুর: রংপুরের পীরগাছা উপজেলার গ্রামগুলোতে নেমে এসেছে নীরব আতঙ্ক অ্যানথ্রাক্স। গবাদিপশুর অসুস্থতা থেকে শুরু হওয়া এক ব্যাধি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গে আবদুর রাজ্জাক (৪৫) ও কমলা বেগম (৬০) এর মৃত্যুর পর শোক ও উৎকণ্ঠায় গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়। শুধু তাই নয়, অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ ভুগছেন একই উপসর্গে।
শোকের মাতমে গ্রামগুলো
আবদুর রাজ্জাকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মৃত্যুর গল্প পরিবারের অশ্রুসিক্ত স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার স্ত্রী ফেনসী বেগমের চোখে এখনও সেই দিনের কষ্ট। তিনি জানান, চাচা শ্বশুরের গরু অসুস্থ হয়ে পড়লে জবাই করা হয়। রাজ্জাককে ডেকে মাংস কাটাকাটি করানো হয়। সেখানে তার আঙুল কেটে যায়, বিকেল থেকে জ্বর আসে শরীরে। হাত, কানের নিচে, বুক ফুলে যায়। তিন দিন পর রংপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন।
কথাগুলো বলতে বলতে ফেনসীর গলা ধরে আসে। রাজ্জাকের মতোই কমলা বেগমের নাতি সুমন মিয়া বলেন, দাদি, বাবা এবং আমার ছেলে তিনজনই অসুস্থ। গরুর মাংস খেয়ে এমন হয়েছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা এসে মাংস পুঁতে রাখল, কিন্তু দাদি আর ফিরলেন না।

অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ চলছে। ছবি: সারাবাংলা
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, অবহেলার অভিযোগ
পীরগাছা, তাম্বুলপুর, ছাওলা ও পারুল ইউনিয়নে ঘুরে দেখা গেছে অন্তত ৫০ জন আক্রান্ত। স্থানীয়রা জানান, গত দুই মাসে মারা গেছে তিন শতাধিক গবাদিপশু। কিন্তু উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি। স্থানীয় মোবারক আলীর কথায় ফুটে উঠেছে গ্রামীণ অসহায়ত্ব। তিনি বলেন, ‘আমরা আতঙ্কে আছি। গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছি, কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি।’
অ্যানথ্রাক্স: নীরব হত্যাকারী
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি জুনোটিক রোগ, যা গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়। বাংলাদেশে এটি এন্ডেমিক, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় বেশি ছড়ায়। মানুষে ত্বকের ঘা, জ্বর, ফোলা; পশুতে হঠাৎ মৃত্যু, রক্তক্ষরণ যার লক্ষণ। পশুর ভ্যাকসিনেশন, অসুস্থ পশু জবাই না করা, মাংস সঠিকভাবে রান্না যা প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে হাজার হাজার সাসপেক্টেড কেস, কিন্তু রিপোর্টিং কম। রংপুরে সাম্প্রতিক আউটব্রেক মিড-আগস্ট থেকে শুরু, ২০০ এর বেশি আক্রান্ত, যা অসুস্থ গরুর মাংস কাটা এবং খাওয়া থেকে।
আনন্দ ধনীরাম গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাজিয়া বেগমের (৪৫) হাতে ঘা, যা মাংস কাটার পর দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ভয়ে রাতে ঘুম হয় না, রান্নাবান্না কিছুই করতে পারিনা; ছেলেমেয়েরা কী খাবে? তার কথায় যেন গ্রামের সবার কষ্ট ফুটে ওঠে। নগরজিৎপুরে মাংস বিতরণের পর মোন্নাফের পরিবারে ৭-৮ জন অসুস্থ। এই করুণ অবস্থা শুধু রোগের নয়, অবহেলারও দৃশ্য তা অনুমেয়।
পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত জানান, ১০-১২ জন চিকিৎসা নিয়েছে। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, অর্ধশতের বেশি। আক্রান্তদের অভিযোগ সময়মতো পদক্ষেপ না নেয়ায় বেশি ছড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের ধীরগতি, ক্ষোভ বাড়ছে
প্রাণিসম্পদ বিভাগ দাবি করছে, ইতিমধ্যে ৩৪ হাজারের বেশি পশুকে টিকা দেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ—সময়মতো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আইইডিসিআর ইতোমধ্যে আক্রান্ত এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে। তবে পরিবারের কাছে সেই সান্ত্বনা দেরিতে আসছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স ৯৫% ক্ষেত্রে ত্বকের, চিকিৎসায় সারে, কিন্তু অজান্তে মারাত্মক হয়। বাংলাদেশে ২০০৯-২০২০ সালে ৪০০০ হাজারের বেশি সাসপেক্টেড কেস, কিন্তু প্রতিরোধের অভাবে ছড়ায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সচেতনতার অভাব প্রধান কারণ। গ্রামবাসীরা অসুস্থ পশু জবাই করে মাংস বিতরণ করে, যা রোগ ছড়ায়। স্বাস্থ্য বিভাগের সময়মতো হস্তক্ষেপ না থাকায় আক্রান্ত বাড়ছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা একরামুল হক মণ্ডল বলেন, অ্যানথ্রাক্স ঠেকাতে মাঠপর্যায়ে তদারকি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৩৩৭টি গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স রোগ নির্মূলে টিকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অসুস্থ গবাদিপশু জবাই না করতে উঠান বৈঠক, লিফলেট বিতরণসহ সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবু ছাঈদ বলেন, আক্রান্ত পশুর নমুনা পরীক্ষায় অ্যানথ্রাক্স নিশ্চিত হয়েছে। আমরা আক্রান্ত গবাদি পশুর চিকিৎসায় সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত পীরগাছা ও আশেপাশের উপজেলায় প্রায় ৩২ হাজার পশুকে অ্যানথ্রাক্সের টিকা দেয়া হয়েছে। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
যদিও এ ব্যাপারে শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদফতর নির্বিকার থাকলেও পরে নড়েচড়ে বসে। রোববার দিনব্যাপী পীরগাছা উপজেলার মাইটাল এলাকায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। এসময় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া আব্দুর রাজ্জাকের বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিরা। পরে দিনব্যাপী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি নানা তথ্য সংগ্রহ করে তারা।
প্রতিনিধি দলের প্রধান ও আইইডিসিআর এর মেডিকেল অফিসার ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়েছে এমন সংবাদ প্রচারের পর আমরা আইইডিসিআর-এর একটি টিম যারা অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত আমরা তাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি নমুনা ও সকল ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছি। এই নমুনা আইইডিসিআর এ পরীক্ষার পার নিশ্চিত করে বলা যাবে অ্যানথ্রাক্স কি না।
সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা জানান, “নমুনা সংগ্রহের পর ফলাফলের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সরকারের অবস্থান
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, আমরা কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চাই না যে অ্যানথ্রাক্স মানুষের মধ্যে ছড়াক। প্রাণি থেকে মানুষের মধ্যে জুনোটিক রোগ ছড়ানোয় এটা অনেক মারাত্মক হতে পারে। সে জন্য এই রোগ যেন পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাণির রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষকে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ। প্রাণিকে রোগমুক্ত করতে ভ্যাকসিন উৎপাদনের টার্গেট নিয়েছি।
তিনি ওয়ান হেলথ কনসেপ্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে কাজ করছি যাতে প্রাণি থেকে মানুষে রোগ ছড়ানো রোধ হয়।