লোহার ফটক ভেঙে মানুষ দলে দলে ঢুকে পড়ছে সুসজ্জিত এক ভবনে। ভেঙে যাচ্ছে জানালা-দরজা, শিল্পকর্ম, ভেতরের দামি আসবাব। অনেকে তুলে নিচ্ছে জাঁকজমকের প্রতীক সেই বস্তুগুলো। দৃশ্যটা যেন কোনো সিনেমার, অথচ বাস্তবে এটি ঘটেছে সম্প্রতি নেপালে। এর আগে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় এবং গত বছর বাংলাদেশেও তরুণদের আন্দোলনে পতন ঘটেছে সরকারের। চার বছরে তিন দেশে একই চিত্র—এখন প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি দক্ষিণ এশিয়া জেন-জির অভ্যুত্থানের নতুন উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠছে?
তরুণদের বিদ্রোহ: ভিন্ন দেশ, ভিন্ন কারণ
নেপালে কেপি শর্মা অলির সরকার পতন ঘটল মাত্র তিন দিনের আন্দোলনে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী তরুণদের দাবি নিয়ে উপহাস করেছিলেন—যা ক্ষোভকে আরও উসকে দিয়েছিল। বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন দমন করতে পুলিশের সহিংসতা তরুণদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল। শ্রীলঙ্কায় অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে ক্ষুধার্ত মানুষ রাজপথে নেমেছিল।
কারণ ভিন্ন হলেও তিন দেশেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভের নেতৃত্ব নিয়েছে তরুণ প্রজন্ম।
ডিজিটাল ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন
নেপালে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়া হয়েছে প্রচলিত ব্যালটে নয়, বরং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ডিসকর্ডে ভোটের মাধ্যমে। দশ হাজার তরুণের অংশগ্রহণে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তরুণদের ডিজিটাল অংশগ্রহণ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একেবারেই নতুন।
দুর্নীতি, বৈষম্য ও প্রজন্মগত ব্যবধান
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি মনে করেন, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে দুর্নীতি ও বৈষম্য চরমে উঠেছিল। অথচ রাজনৈতিক নেতৃত্ব চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। নেতাদের বয়স ছিল সত্তরের ওপরে—যা তরুণদের সঙ্গে এক গভীর প্রজন্মগত ব্যবধান তৈরি করেছে। রাজনীতিবিদদের সন্তানরা বিলাসী জীবনে, আর সাধারণ তরুণেরা বেকারত্ব ও অদৃশ্য ভবিষ্যতের অন্ধকারে—এই তীব্র বৈপরীত্যই ক্ষোভকে বিস্ফোরণে রূপ দিয়েছে।
“ভালো রাজনীতি চাই”
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, “এই তিন দেশের আন্দোলনে মিল আছে একটি জায়গায়—তরুণেরা আরও ভালো রাজনীতিক চায়, ন্যায্য অর্থনীতি চায়। তারা বাস্তবতার সঙ্গে তাদের কল্পনার জীবনের মিল খুঁজছে।”
আন্দোলনের অনুপ্রেরণা
বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের আন্দোলন একে অপরকে অনুপ্রাণিত করেছে। তরুণেরা একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা শুধু প্রতিবাদ নয়, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও ভাগাভাগি করেছে।
এরপর কোথায়?
প্রশ্ন এখন একটাই—এরপর কোন দেশে ঘটবে এমন বিদ্রোহ? বিশ্লেষকেরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতায় যদি দুর্নীতি, বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতির অবসান না ঘটে, তবে জেন-জির নেতৃত্বে নতুন অভ্যুত্থান যে কোনো সময় অন্যত্রও ঘটতে পারে।