রাজবাড়ী: রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মদাপুর ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত নূর নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদ ইমনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ এবং কলেজ প্রতিষ্ঠাতাকে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ উঠেছে। কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা প্রবাসী আব্দুস সালাম তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর গত ৯ জুলাই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আমেরিকা প্রবাসী মুহাম্মদ আব্দুস সালাম লিখিত অভিযোগে বলেন, আমার কষ্টার্জিত অর্থে গড়া ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতে কলেজের অধ্যক্ষ ও তার ভাতিজা মাহমুদুর রশিদ ইমন জড়িত।
অভিযোগে আব্দুস সালাম জানান, গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১৫ সালে তিনি মায়ের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার মানোন্নয়নে তিনি বিদেশ থেকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। জুন ২০২২ থেকে অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিকাশের মাধ্যমে প্রায় ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। কিন্তু অধ্যক্ষ কোনো সঠিক হিসাব দেননি।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, আমার পাঠানো অর্থ দিয়ে আমার নামে জমি কেনার কথা থাকলেও তা নিজ নামে রেজিস্ট্রি করেছেন অধ্যক্ষ। এছাড়া আমার স্ত্রীর নামে কুমকুম দারুস সালাম মহিলা হাফেজিয়া মাদরাসা ও বাবার নামে গফুরিয়া হাফেজিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করি। ওই প্রতিষ্ঠানের সব খরচ আমি বহন করতাম। দুই মাদরাসার দায়িত্ব দেওয়া হয় কলেজ অধ্যক্ষ মো. মাহমুদুর রশিদকে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। আমি হিসাব চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে সহযোগীদের সঙ্গে মাদরাসার কম্পিউটার, প্রিন্টার, ক্যামেরা ও কাগজপত্র নিয়ে যান। এ সময় স্থানীয় রাকিবুল হাসান স্বপন ছাত্রীদের ভয়ভীতি দেখায় এবং মাহমুদুর রশিদসহ তার লোকজন রাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। ভয়ে একে একে ছাত্র-শিক্ষকরা চলে গেলে মাদরাসা দুটিই বন্ধ হয়ে যায়। আমি এ ঘটনার ন্যায়বিচার চাই।
তিনি জানান, শুধু উপার্জিত অর্থ হারিয়েই নয়, প্রাণনাশের আশঙ্কাতেও ভুগছেন আমেরিকা প্রবাসী আব্দুস সালাম। তাই তিনি জীবনের নিরাপত্তা, প্রেরিত টাকা ফেরত ও প্রতারকের বিচার চেয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতর, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ করেছেন তিনি।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানান, সরকারিভাবে কোনো সহায়তা না এলেও কলেজটি দ্রুতই সুনাম অর্জন করে। তবে অধ্যক্ষের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাতার বিরোধের কারণে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা বেতন পাননি।
কলেজের সহকারী লাইব্রেরিয়ান টুম্পা জানান, কলেজ থেকে যে বইগুলো কেনা হয় তার ভাউচার অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদ স্যার আমাকে দেন না। এছাড়া খাতা ও পোশাকের খরচের ভাউচারও তিনি দেননি। সর্বশেষ তিনি ২০২৫ সালের জুলাই মাসে আমার কাছে যে হিসাবের খাতা ছিল সেখানে হিসাব লিখিয়ে আমার কাছ থেকে খাতাটা নিয়ে গেছেন তিনি।
অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ইতোমধ্যেই দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বোর্ডের সহকারী কলেজ পরিদর্শক মোহাম্মদ লোকমান মুন্সি ও সেকশন অফিসার মো. হিরু শেখ ১৩ সেপ্টেম্বর সরেজমিন তদন্ত করেছেন। তদন্ত কমিটির কাছে কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহমুদুর রশিদের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ও আয়-ব্যয়ের ভাউচার দেখাতে পারেননি বলে জানা গেছে।
তদন্তকারী দল ১১টি বিষয়ের মধ্যে – কলেজের পাঠদানের অনুমতিপত্র, কলেজের নামে জমির কাগজ, প্রথম ও শেষ কমিটির কাগজ, শেষ অনুমতিপত্র, অধ্যক্ষসহ শিক্ষক কর্মচারীর নিয়োগ সংক্রান্ত সকল কাগজ, অডিট রিপোর্ট হালনাগাদ, বিগত ৩ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল, বিগত দুই শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থীর সংখ্যা, কলেজের অ্যাকাউন্ট এবং অধ্যক্ষের ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্ট এবং কলেজ লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যার কাগজপত্র ও প্রমাণাদি আগামী ৭দিনের মধ্যে বোর্ডে জমা দেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
তদন্ত কার্য শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তদন্তকারী দল অভিযোগের সত্যতা বা অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণ পেয়েছেন কি না সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা কোন মন্তব্য তারা করেননি। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদ ইমন বলেন, ‘এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুস সালাম সে আমার আপন কাকা। তিনি যে টাকা পাঠাতেন তা কলেজের পিছনে খরচ করেছি, তার এনজিওতে দিয়েছি, মাদ্রাসাতে খরচ করেছি। এছাড়া আত্মীয় স্বজনসহ বিভিন্নজনকে তার নির্দেশে টাকা দিয়েছি। কলেজে বই কিনেছি, ড্রেস কিনেছি, শিক্ষকদের বেতন দিয়েছি সবই ওই টাকা দিয়ে। কলেজে আমি কোন দুর্নীতি বা অর্থ আত্মসাৎ করিনি।’
তিনি বলেন, ‘সব ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে। প্রতিমাসে সব খরচের হিসাব দেওয়া হয়েছে। এরপরও তিনি চাইলে উকিল ও তার আপন কাওকে পাঠিয়ে সঠিক হিসাবটি বুঝে নিতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাকা কলেজটি বন্ধ করতে চান, তাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন। এ কারনে তিনি কলেজের খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, কিন্তু আমি চাই কলেজটি চলুক।’