নেপালের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকি বলেছেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে পদ থেকে মুক্তি চাই। দায়িত্ব নেওয়ার পর বিবিবিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর নেপালের তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামে দুর্নীতি, সরকারবিরোধী নিপীড়ন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে। এর পরদিন আরও জোরালোভাবে বিক্ষোভ শুরু হলে বিভিন্ন স্থানে সরকারি ভবন ও নেতাদের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। চূড়ান্ত চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
পরে ১২ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের মধ্যেই সুশীলা কারকি নেপালের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। সাবেক এই বিচারপতি এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করছেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পরে গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রথম সাক্ষাতকারে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে ২০২৬ এর পাঁচই মার্চ। সময়মতো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে আপনাকে?। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো বলেছি, আমি দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করব। আপনি জানেন, সাধারণ মানুষের দিক থেকে কতটা চাপের মুখে এই সরকার গঠিত হয়েছে। আমি আমার দায়িত্ব ছয় মাসের মধ্যে শেষ করে পদ থেকে সরে যেতে চাই। আগামী কয়েক দিনে নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় করে তুলব আমরা। প্রথমত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে তাদের। একটা পুরনো ভোটার তালিকা আছে তাদের, কিন্তু সেটা হালনাগাদ করতে হবে। যদি দিনরাত কাজ করতে পারি তাহলে ছয় মাসে সেটা করা সম্ভব। যেদিন আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেব, সেদিন থেকে আমি মুক্ত।‘
দুর্নীতির অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত করার জন্য কোনো কমিশন গঠনেরও পরিকল্পনা কি আছে আপনার?। জবাবে সুশীলা কারকি বলেন, ‘প্রথমে আমরা ১০-১১ জন সদস্যের একটা মন্ত্রীসভা গড়ব। কয়েকদিনের মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। কী আকারে দুর্নীতি হয়েছে, সেটা আগে জানা প্রয়োজন। আমরা যদি তদন্ত শুরু করতে পারি, পরবর্তী সরকারও সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পার। আমাদের মনে হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতক্ষণ না তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ততদিন পর্যন্ত এই জাতি শান্তি পাবে না। আমরা নিশ্চিতভাবেই এটা (দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত) করব।’
জেন জি-র আন্দোলন চলাকালীন নেপালে যেসব সম্পত্তি ও জীবনহানির ঘটনা হয়েছে, তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটা উচ্চপর্যায়ের কমিশন গঠন করেছে সরকার। সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিবিসি জানতে চেয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমান মন্ত্রীসভায় আমরা মাত্র চারজন সদস্য আছি। আমাদের হাতে সময় রয়েছে ছয় মাস। এই ছয়টি মাসকে আমরা যতটা সম্ভব কাজে লাগাতে চাই। আমাদের পরিকল্পনা হল ওই তদন্ত এক মাসের মধ্যে শেষ করার, বা বড়জোর দেড় মাস। বিভিন্ন ক্ষেত্রের তিনজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে এই তদন্ত চালানো হবে।’
মন্ত্রীসভা নিয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি (রামচন্দ্র পৌড়েল) বলেছিলেন, প্রতিটা রাজনৈতিক দল থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করতে। আমি বলি, এটা অনুচিত হবে। (আমি বলি যে মন্ত্রীসভা) অরাজনৈতিক হওয়া উচিত এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিদেরই রাখা উচিত। আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের, দলিত, নারী ও অনগ্রসর শ্রেণির সদস্যদের যাতে যতটা সম্ভব রাখা যায়, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। অনেক নাম এসেছে। কিন্তু আমরা এটা যাচাই করে দেখছি যে তারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কী না। যদি তা হয়, তাহলে আমরা তাদের বদলে অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আনার চেষ্টা করব, অথবা সাবেক সচিবদের, আদিবাসী গোষ্ঠী, দলিত, নারী ও অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের নিয়ে আসা যেতে পারে।’
রাষ্ট্রপতি যে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে রাজনৈতিক দলগুলির সদস্যদের নেওয়া হোক, যাদের হয়তো অভিজ্ঞতাও আছে, সেই পরামর্শ মানতে অস্বীকার করলেন কেন আপনি?। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল যে যদি রাজনৈতিক সদস্যদের বেছে নিই, নির্বাচনের সময়ে তার অপব্যবহার হতে পারে। কারণ নির্বাচনের সময়েও মন্ত্রীসভার হাতে তো কিছু ক্ষমতা থাকবে, যেমন হেলিকপ্টার ব্যবহার ইত্যাদির মতো সুবিধা। আর আমি সেরকম ব্যক্তিই বেছে নিতে চেয়েছিলাম যারা নির্বাচনে লড়াই করবেন না। নাহলে তো (মন্ত্রীসভার) সেই সব সদস্য নির্বাচনে লড়াই করবেন।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধা আছে যে তারা পরামর্শ নিতে পারে, যেটা আপনার নেই। চয়ন প্রক্রিয়া কীভাবে চলছে?। তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু বন্ধু আছেন, যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। আমরা তাদের পরামর্শ নিচ্ছি আর মাঠ পর্যায়তেও কাজ করছি আমরা। আবার ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে যে (মন্ত্রীসভায় যোগ দেওয়ার ব্যাপারে) তার সদিচ্ছা আছে কিনা। তিনজন সদস্যকে আমরা ইতোমধ্যে নিযুক্ত করেছি। বাকিদের আমরা মঙ্গলবারের মধ্যে চূড়ান্ত করে ফেলব। এটা একটা নির্বাচনি প্রক্রিয়া। ভারতে টিএন শেষন (ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার) যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতেন, সেভাবেই ভোট হওয়া উচিত। প্রতিটা বিষয় আইন আর নিয়ম অনুযায়ী হবে। কোনো ত্রুটি যাতে না থাকে। একটা সুষ্ঠু সরকার গঠিত হোক। আমরা সবাই মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি যাতে একটা সুষ্ঠু সংসদ গঠন করা যায় (ভোটের পরে)।’
একটা নতুন সরকারের দাবি যে গোষ্ঠীটি তুলেছিল, ইতোমধ্যেই তো তারা প্রতিবাদ করছে। আপনিও নিশ্চই শুনেছেন বিষয়টা। (এই পরিস্থিতির) কীভাবে মোকাবিলা করার পরিকল্পনা করছেন আপনি?। সুশীলা কারকি বলেন, ‘হ্যাঁ, সেই গোষ্ঠীটিই তো সরকার গড়ার জন্য আমাদের নাম প্রস্তাব করেছিল। আমরা তো পদ চাই নি। এটা আমাদের সিদ্ধান্তও ছিল না। যখন আটই সেপ্টেম্বর ছাত্রদের হত্যা করা হল, আমরা এতটাই মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম যে ব্যাপক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বেনিয়ম আর সুশাসনের অভাব নিয়ে ওরা যে দাবিগুলো তুলছিল, তা পূরণ করতে চেয়েছিলাম আমরা। কোনো কিছুতেই তো ১০০ শতাংশ সাফল্য বলে কিছু হয়নি। হয়ত আমরা সবগুলো দাবি পূরণ করতে পারব না, কিন্তু আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করব। আমরা সব দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করব কিন্তু যদি কিছু অপূর্ণ থেকে যায় তাহলে পরবর্তী সরকার আর সংসদ (নির্বাচনের পরে) সেগুলোর দায়িত্ব নেবে।’