Wednesday 17 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাইব্যুনালে নাহিদ ইসলাম
ন্যায্য আন্দোলন হলেই রাজাকার আখ্যা শেখ হাসিনা’র

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২১:৩৯ | আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:২২

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম

ঢাকা: কেনো ন্যায্য আন্দোলন হলেই রাজাকার আখ্যা দিয়ে নস্যাৎ করতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যায়িত করেন তিনি। তার এমন বক্তব্যে অপমানিত বোধ করেন সারাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা। ফলে ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এমন তথ্য। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৪৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

বিজ্ঞাপন

নাহিদ বলেন, ‘একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৫ জুন সরকারের কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিলপূর্বক কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করেন হাইকোর্ট। ওই দিনই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করি। পরবর্তীতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এ রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়। আমরা হাইকোর্টের রায়টি স্থগিত চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মারকলিপি দেই। একইসঙ্গে ৩০ জুনের মধ্যে কোটা সংস্কার সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছিলাম। কিন্তু ৩০ জুনের মধ্যে সরকার কোনো সাড়া দেয়নি। এজন্য ১ জুলাই থেকে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটাপ্রথার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে আন্দোলন শুরু করি। ২, ৩ ও ৪ জুলাই আমাদের আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচি ছিল।’

তিনি বলেন, ‘৪ জুলাই আপিল বিভাগে কোটা সংক্রান্ত বিষয়ে আদেশ প্রদানের কথা থাকলেও সেদিন কোনো শুনানি হয়নি। ফলে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। একপর্যায়ে বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বিধায় কিছু করার নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। কোনো বক্তব্য থাকলে আদালতে গিয়েও বলতে বলা হয়েছিল। তখন আমরা জানতাম বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করে সরকার। এ কারণে আদালতে না গিয়ে রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখি। এ ছাড়া আন্দোলন তীব্রতর করার লক্ষ্যে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে ৭ জুলাই সারাদেশে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করি। সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনে অংশ নেন।‘

এনসিপির এই আহ্বায়ক বলেন, ‘১০ জুলাই হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত না করে এক মাসের স্থিতাবস্থার আদেশ জারি করেন আপিল বিভাগ। আমরা এতে হতাশ হই। একইসঙ্গে বিচার বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না বলে আমরা নিশ্চিত হই। এরপর আমাদের দাবি কিছুটা পরিবর্তন করে সরকারি চাকরিতে সব পর্যায়ে কোটাপ্রথার যৌক্তিক সংস্কার দাবি করি। আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই। আমরা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের গেট বন্ধ করে দেয় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ। ছাত্ররা যে আন্দোলনে অংশ নিতে না পারে। আমাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দেওয়া হয়। সারাদেশেই এ ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবু আমরা আন্দোলন অব্যাহত রাখি। এ ছাড়া সারাদেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি সমন্বয়ক কমিটি ঘোষণা করি।‘

এই সাক্ষী আরও বলেন, ‘গত বছরের ১৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ওই রাতে একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি অভিহিত করে কোটাপ্রথার পক্ষে অবস্থান নেন শেখ হাসিনা। মূলত এ বক্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণের একটি বৈধতা দেওয়া হয়। কারণ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ন্যায্য আন্দোলন করা হলে রাজাকার আখ্যা দিয়ে আন্দোলনের ন্যায্যতা নস্যাৎ করা হতো বলে আমরা সবসময় দেখেছি। তাই ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যায়িত করায় গোটা দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা অপমানিত বোধ করেন। সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল এ বক্তব্য প্রত্যাহারপূর্বক আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে।‘

‘এরপর ১৫ জুলাই আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই। একই দিন পালটা কর্মসূচির ডাক দেয় ছাত্রলীগ। সেদিন আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তার এই ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে ব্যাপক নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগ। নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়। কারণ তারা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন। হামলাকারীদের মধ্যে নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক ইনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শয়ন, সাধারণ সম্পাদক সৈকত। তারা বাইর থেকেও সন্ত্রাসীদের এনে জড়ো করেছিল। এ হামলায় বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্র-ছাত্রীদের ওপরও তারা নির্যাতন চালায়। একইসঙ্গে চিকিৎসায় বাধা দেয়।’

তিনি বলেন, ‘এ হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই আমরা। ওই দিন পুলিশের গুলিতে শহিদ হন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ। চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ছয়জন ওই দিন আন্দোলনে শহিদ হন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৭ জুলাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা দেই। কিন্তু দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় ইউজিসি। সেদিন যাত্রাবাড়ীতে একজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়। একই দিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে ফেলে বিজিবি, পুলিশ ও র‍্যাব। গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল শুরু করলে মিছিলে সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। আমাদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয় পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেদিন আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহারসহ সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য চাপ দেয় ডিজিএফআই। এ ছাড়া ওই দিন হলের বিদ্যুৎ, পানি ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের সঙ্গে সংলাপে আমরা অস্বীকৃতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানাই।‘

এদিন বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নাহিদের সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তবে শেষ না হওয়ায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর সহিদুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা। এ ছাড়া শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।

সারাবাংলা/আরএম/এইচআই

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এনসিপি নাহিদ ইসলাম মানবতাবিরোধী অপরাধ শেখ হাসিনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর