Thursday 18 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইসলামিক দলগুলোর অভিন্ন কর্মসূচি ‘কৌশলগত ঐক্য’র সূচনা!

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:০০

ইসলামিক দলগুলো দিয়েছে অভিন্ন কর্মসূচি। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ’২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে দাবি নিয়ে রাজপথে খুব কমই দেখা গেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) সঙ্গে জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামিক দলকে রাজপথে দেখা গিয়েছিল। এর আগে বা পরে রাজপথে তেমন একটা রাজনৈতিক উত্তাপ ছিল না বললেই চলে। তবে এবার ইসলামিক দলগুলো জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন ও প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি চালু নিয়ে রাজপথে নামতে যাচ্ছে।

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আড়ালে থাকা শক্তি। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান তিনটি ইসলামিক দল— ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’, ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও ‘খেলাফত মজলিস’ একই দিনে প্রায় অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ঢাকা, বিভাগীয় শহর, এমনকি জেলা-উপজেলা পর্যায়েও সমাবেশ ও বিক্ষোভের এই ঘোষণা রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠছে— এটি কি নিছক কাকতালীয়, নাকি ইসলামিক দলগুলোর মধ্যে কৌশলগত ঐক্যের সূচনা?

বিজ্ঞাপন

রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে পুনরুত্থান

বাংলাদেশে ইসলামিক দলগুলো কখনো এককভাবে, কখনো বড়দলের জোটে থেকে রাজনীতি করেছে। বিএনপি জোটে জামায়াতের অংশগ্রহণ কিংবা খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলনের স্বতন্ত্র কার্যক্রম তার উদাহরণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ এবং ‘জুলাই ঘোষণা’ দেশের রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামিক দলগুলো দেশের রাজনীতিতে ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে। জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন, পিআর পদ্ধতি চালু ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে তারা।

তিন দলের ঘোষিত কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়— ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ। ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ। ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমাবেশ। শুধু জামায়াতে ইসলামী বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মাথায় রেখে ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বরের সময় কিছুটা পরিবর্তন করেছে। তবে কর্মসূচির ধরন ও রাজনৈতিক লক্ষ্য একই।

তিন দলের রাজনীতিতে মিল-অমিল

তিন দলই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। তারা সবাই পিআর পদ্ধতির দাবিতে একমত। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিও তাদের এক। কিন্তু জামায়াতের বিতর্কিত অতীত ও আন্তর্জাতিক সংযোগ তাদের এখনো প্রশ্নবিদ্ধ করে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক বিকল্প রাজনীতির কথা বলে। খেলাফত মজলিস সরাসরি খিলাফতভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি তোলে।

কর্মসূচি কাকতালীয় নাকি কৌশলগত সমন্বয়

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একদিনে অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণার পেছনে নিছক কাকতালীয় ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। বরং, এখানে কৌশলগত সমন্বয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পৃথকভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও মাঠে একইদিনে ইসলামী দলগুলোর সমর্থকরা রাস্তায় নামবে, ফলে শক্তির প্রদর্শন দেখা যাবে। একসঙ্গে মাঠে নামলে গণমাধ্যমে কাভারেজ এবং জনমনে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ বাড়বে। অনেকে এটিকে ইসলামী ভোটব্যাংক সক্রিয় করার একধরনের ‘ট্রায়াল রান’ বা ‘মহড়া’ হিসেবেও দেখছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একই দিনে তিনটি ইসলামিক দলের কর্মসূচি নিছক সময় সাপেক্ষ ঘটনার মতোও নয়। রাজনীতিতে তারা সক্রিয়ভাবে নিজেদের অবস্থান পুনঃস্থাপন করতে চাচ্ছে। কর্মসূচিতে তারা নিজেদের ভিন্ন ইস্যু ও স্বতন্ত্র আদর্শ বজায় রাখার কথা বললেও জনমত আকর্ষণ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য পরিকল্পিতভাবে একসঙ্গে মাঠে নামছে তারা। একসঙ্গে কর্মসূচি নেওয়া তাদের জনসংযোগ সক্ষমতা, স্থানীয় নেতা ও সমর্থকের কার্যকারিতা যাচাইয়েরও একধরনের ‘ট্রায়াল রান’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক শোডাউন নয়, এটি ভোটারদের মনোভাব যাচাই ও ভবিষ্যতের জোট রাজনীতির প্রস্তুতি বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

যা বলছে দলগুলো

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আগেই ঘোষণা দিয়েছি, সংবাদ সম্মেলন করেছি। দাবি কাছাকাছি হলেও ধরণ আলাদা। তবে ইসলামিক দল হিসেবে চিন্তার জায়গায় মিল থাকতেই পারে। আর যেকোনো কর্মসূচিই রাজনৈতিক একটি কৌশল, এটি অবশ্যই সঠিক। সেটা দেশ ও জনগণের স্বার্থে হলে তো সমস্যাই নেই। এমনকি একই দাবিতে কর্মসূচির বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করারও কিছু নেই। বরং, ৫ দফা দাবিগুলো পূরণ হলে দেশের মানুষ উপকৃত হবে।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এক নেতাও নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দল আগেই এ বিষয়ে কয়েকবার বৈঠক করেছে। আমরা ভেবেছিলাম, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সবাই একমত হবে। কিন্তু তা হয়নি। তাই আমরা দাবি আদায়ে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে কৌশলী হওয়ার কিছু নেই। দাবি আদায়ে আন্দোলন প্রয়োজন, তাই কর্মসুচি দেওয়া।’ তবে খেলাফত মজলিসের নেতারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। যদিও তাদের এক নেতা বলেছেন, ‘এ বিষয়ে কর্মসূচিতেই বিস্তারিত জানানো হবে।’

ইসলামিক দলগুলোর এই ‘কৌশলী আন্দোলন’ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আলোচনা চলমান থাকার পর আন্দোলনের ডাক দেওয়া আলোচনার টেবিলকে অসম্মান করা। বেশির ভাগ ইস্যুতেই ঐকমত্য হয়ে গেছে। এখন আন্দোলনের ডাক জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলকে দেশের মানুষ পিআর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে বলেনি। সুতরাং, এটা আলোচনার বিষয় না। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের যদি ইচ্ছা থাকে, তাহলে তাদের অবশ্যই জনগণের ম্যান্ডেন্ট নিয়ে সংসদে আসতে হবে।’

কী হতে পারে

ইসলামিক দলগুলো একত্রিত হলে জাতীয় রাজনীতির সমীকরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে। যদিও এককভাবে তারা নির্ণায়ক শক্তি নয়, তবে গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকায় প্রভাব বিস্তার তাদের বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। ভবিষ্যতে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা কিংবা জোট রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার পথও খোলা থাকতে পারে। এই যুগপৎ কর্মসূচি সেই সম্ভাবনাকে আরও বাস্তবসম্মত করে তুলছে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তবে ‘ঐক্য’ কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, কিংবা এটি নির্বাচনের আগে বড় রাজনৈতিক জোটে রূপ নেবে কিনা— সেটিই এখন দেখার বিষয়।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

অভিন্ন কর্মসূচি ইসলামিক দল জুলাই সনদ পিআর পদ্ধতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর