রংপুর: উজানের পাহাড়ি ঢল আর ভারি বৃষ্টির কারণে তিস্তার নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুরে তিস্তা নদীর পশ্চিম তীরে দ্বিতীয় তিস্তা সেতু রক্ষা বাঁধে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ এই বাঁধের ৬০-১০০ মিটার অংশে সিসি ব্লক ধসে গিয়ে ৭০ ফুটের মতো গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে সেতুটি, লালমনিরহাট-রংপুর আঞ্চলিক সড়ক এবং আশপাশের প্রায় ১২০০ পরিবার।
স্থানীয়রা বলছেন, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা, কারণ এই ভাঙন যেন তাদের জীবনের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, এই সমস্যা নতুন নয়। গত দুই বারের বন্যায়ও বাঁধে ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো সংস্কার করেনি।
এদিকে এই ভাঙনের দায় নিয়ে রশি টানাটানি চলছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর মধ্যে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, বাঁধটি সেতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের হাতে নেই। অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুসা বলেন, আমরা খবর নিয়েছি, একটি টিম কাজ করছে। কিন্তু পানি বেশি থাকায় পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। পানি কমলে দ্রুত মেরামত করা যাবে।
নজরুল ইসলাম নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, প্রথমে ছোট ফাটল ছিল। চার-পাঁচ মাস ধরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার পানি বাড়তেই একের পর এক ব্লক তলিয়ে যাচ্ছে, নিচে গভীর গর্ত তৈরি হয়ে ভাঙন আরও ভয়াবহ হয়েছে।
কৃষক আজিজুল হকের কথায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হলো। তিনি বলেন, বাঁধ না থাকলে সেতু ভেঙে যেতে পারে। আমাদের গ্রামে স্থায়ী জলাবদ্ধতা হবে, জমি বালুচরে ঢেকে যাবে, চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?
আরেক কৃষক আব্দুস সোবহানের কণ্ঠে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, বাঁধ রক্ষা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো পথ নেই। বসতভিটা, সেতু সব রক্ষা করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, উজানের ঢলে বাঁধের উল্টো দিকে চর পড়ায় পানি সরাসরি আঘাত হানছে। এতে সড়ক ও জনবসতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্রুত জরুরি ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, ভাঙনের বিষয়টি জেলা প্রশাসক এবং এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানানো হয়েছে। তারা দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।
২০১৮ সালে ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সেতু লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের রুদ্রেশ্বরকে গঙ্গাচড়ার মহিপুরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ৮৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ৯.৬ মিটার প্রস্থের সেতুটিতে ১৬টি পিলার এবং ১৫টি স্প্যান রয়েছে। প্রতিদিন ৩০-৩৫ হাজার মানুষ এই সড়ক ব্যবহার করে। বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যা ৩৫ হাজার মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করবে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে তিন-চারটি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণা এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তিস্তার ভাঙন দীর্ঘদিনের সমস্যা। উজানের ঢল, ভারি বৃষ্টি এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এর প্রধান কারণ। বাংলাদেশে নদী ভাঙন বছরে হাজার হেক্টর জমি গ্রাস করে, যা কৃষকদের জীবিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। মহিপুরের এই ঘটনা যেন সেই সমস্যার একটা ছোট্ট চিত্র, যা দ্রুত সংস্কার না হলে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দ্রুত কাজ না করলে সেতুসহ গ্রামগুলো বিপদে পড়বে। বনের সঙ্গে জড়িত। সরকারি দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে, তিস্তার স্রোত যেন মানুষের আশা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আশা করি, এই আতঙ্ক শীঘ্রই দূর হবে, আর মহিপুরের মানুষ শান্তিতে ফিরবে।