Friday 19 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আজ নবাবের জন্মদিন
এখনো সিরাজের রক্তের উত্তরাধিকার বয়ে বেড়াচ্ছেন যারা

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:০৩

বাংলার শেষ স্বাধীন অধপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তার উত্তরাধিকার। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: নবাব মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজউদ্দৌলা। বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন অধপতি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যার পতন ঘটে। তবে পলাশীর প্রান্তর কেবলমাত্র একটি যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এটি এই উপমহাদেশের ভাগ্য পালটে দেওয়া এক ট্র্যাজিক ইতিহাস সৃষ্টির স্থান। ওইদিন ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা আর ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের মুখে পতন ঘটে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের। কিন্তু, ইতিহাসের অমোচনীয় সত্য হলো— সিরাজউদ্দৌলার রক্তধারা এখনও বেঁচে আছে, এক ভিন্ন আঙ্গিকে, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে।

নবাবের উত্তরাধিকাদের যাত্রা

১৭২৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দী খাঁর কন্যা আমেনা বেগমের কোলজুড়ে জন্ম নেন মির্জা মুহাম্মদ। তার বাবা ছিলেন জৈনুদ্দিন আহমদ। পরবর্তী সময়ে মির্জা মুহাম্মাদ ইতিহাসের মহানায়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলা নামে পরিচিতি লাভ করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় তার জীবন স্বল্পায়ু হলেও রক্তধারা এগিয়ে চলে একরামউদ্দৌলা ও সিরাজউদ্দৌলার বংশের ভেতর দিয়ে। সিরাজউদ্দৌলার একমাত্র কন্যা উম্মে জহুরা বেগমকে বিয়ে দেওয়া হয় ভাই একরামউদ্দৌলার ছেলে মুরাদউদ্দৌলার সঙ্গে। সেখান থেকে জন্ম নেয় শমসের আলী, এরপর সৈয়দ লুৎফে আলী, তারপর ফাতেমা বেগম, তারপর হাসমত আরা বেগম। এ ধারার মধ্য দিয়েই আবির্ভূত হন সৈয়দ জাকি রেজা আর জাকির রেজার পুত্র সৈয়দ গোলাম মোর্তজা। জাকির রেজার আবেদনেই ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ সরকার অবশেষে সিরাজউদ্দৌলার উত্তরসূরিকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়। বংশধারা এর পর এগিয়ে আসে মুর্শিদাবাদ থেকে পূর্ববাংলায়, রাজশাহী-খুলনা পেরিয়ে ঢাকায়। এই দীর্ঘ যাত্রার সাক্ষী হয়ে ওঠেন নবাব পরিবারের ষষ্ঠ থেকে নবম প্রজন্ম।

বিজ্ঞাপন

অষ্টম প্রজন্ম সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা

এই রক্তধারার অষ্টম প্রজন্মে জন্ম নেন সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা। তিনি ছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নির্বাহী প্রকৌশলী, একজন দক্ষ সংগঠক ও সততার প্রতীক। দেশের বিদ্যুৎ খাতে তার অবদান অনন্য। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিদ্যুতের টাওয়ার ও খুঁটি দাঁড়িয়েছে তার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে। দেশের যেকোনো প্রান্তে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটলে তিনি ছিলেন সর্বশেষ ভরসা। সহকর্মীদের সংগঠিত ও প্রকৌশলীদের ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় তার দৃঢ় অবস্থান তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ গোলাম মোস্তাফার জীবনধারাও ছিল নবাব পরিবারের ঐতিহ্যের মতোই সেবামুখী। নিজের আয়ের বড় অংশ তিনি ব্যয় করতেন দরিদ্র-অসহায়দের সেবামূলক কাজে। কোনো রাজনৈতিক দলে সরাসরি যুক্ত না থেকেও দেশপ্রেমিক আন্দোলন, সমাজসেবা ও ইসলামী চিন্তায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন। তিনি বলতেন—‘আমার শক্তির জায়গাটা আমার পরিবার। সহধর্মিণী মহীয়সী নারী সৈয়দা হোসনে আরা বেগম ও চার সন্তান আমার জীবনের লাকি চার্ম।’ ইতিহাসের নবাব পরিবার যেমন বাংলার স্বার্থে লড়েছিল, তেমনি সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা নিজের কর্মক্ষেত্রে দেশের বিদ্যুৎ খাতে নিরলস সংগ্রাম চালিয়েছেন।

নবম প্রজন্ম নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা

মহীয়সী নারী সৈয়দা হোসনে আরা বেগম এবং ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফা দম্পতির দেশপ্রেমী পুত্র সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব ওরফে নবাবজাদ আলি আব্বাসউদ্দৌলা নবাব সিরাজউদ্দৌলার নবম বংশধর। তিনি সাংবাদিকতা ও লেখালেখির মাধ্যমে বর্তমান সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। তার প্রতিটি লেখনিতে ফুটে ওঠে নবাব পরিবারের কথা ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেশপ্রেমের অমরগাথা। যেখানে সিরাজউদ্দৌলার নাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ও হারানো শাসনের প্রতীক, সেখানে আব্বাসউদ্দৌলা আরেব সমকালীন সমাজের কণ্ঠস্বর। ইতিহাসের উত্তরাধিকার তার হাতে এসে পরিণত হয়েছে কলমের শক্তিতে।

নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি গর্ববোধ করি এ কারণে যে, আমি নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের বংশধর। আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নাই। পাকিস্তান ও ইরান আমাদের পারিবারিক সূত্র জানে। কিন্তু বাংলার টানে ফের এই বাংলাদেশেই ফিরে আসা। নবাব পরিবারের অষ্টম বংশধর আমার পিতাও এই বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। কিন্তু সবাই আমার মতো সাহস করে সম্মুখে আসেনি। কারণ, এখনও নবাব পরিবারকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়, ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চলে। কিন্তু আমি নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। তিনি তার দেশের জন্য লালিত স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারেননি। আমি এই বাংলার জন্য কাজ করে, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে, নবাবের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’

বংশধরদের ভেতর নবাবের ছায়া

সিরাজউদ্দৌলার জীবন ছিল সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও হারানোর ইতিহাস। ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ গোলাম মোস্তাফার জীবন ছিল সেবা, সততা ও অবদানের প্রতিচ্ছবি। আর আব্বাসউদ্দৌলা আরেবের জীবন আজকের সময়ের এক বাস্তবতা— যেখানে ইতিহাসের গৌরব আর সমকালীন সংগ্রাম একসূত্রে বাঁধা। রক্তধারার এই দীর্ঘ যাত্রা মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস কেবল অতীত নয়— এটি বেঁচে থাকে মানুষের জীবন, কর্ম ও উত্তরাধিকারে।

গবেষকরা যা বলছেন

ইতিহাস ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুহাম্মদ তারিক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস অনেকটাই বিকৃতি হয়ে গেছে। যুদ্ধটা মূলত শুরু হয়েছিল খাজনা নিয়ে। মোঘল সম্রাটরা ইংরেজদের খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন ভারতে ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলার দাবি ছিল, যেহেতু আমরা মোঘল সম্রাটদের খাজনা দিই, সেহেতু তোমাদের কাছ থেকে খাজনা নিব। এভাবেই পলাশীর যুদ্ধটা শুরু খাজানা নিয়ে। তাহলে সিরাজউদ্দৌলা সাম্রাজ্য হারালেন কেন? মিরজাফর ও জাতীয় বেইমানদের জন্যই তাকে রাজ্য হারাতে হয়েছে।’

বর্তমানে নবাবের উত্তরাধিকারদের নিয়ে এই ইতিহাস বিশ্লেষক বলেন, ‘আমরা যদি ইউরোপের দিকে তাকাই দেখবেন যে, স্পেন ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলোতে এখনও রাজা-রানি রয়েছে। এই রাজবংশ বা রাজপরিবাররা রাষ্ট্র শাসন করেন না। কিন্তু তাদের রাষ্ট্র সম্মান দেয়। আবার ভারত তিন ভাগ হয়ে গেল। সেখানেও মোঘল হিন্দু সম্রাটদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে, রেশন দিচ্ছে, লেখাপড়ার বৃত্তি দিচ্ছে। সেটা সাংবিধানিকভাবেই দিচ্ছে। একইভাবে পাকিস্তানও কিন্তু তাদের দেশে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশধররা আছেন, তাদের সাংবিধানিকভাবে সাপোর্ট দিচ্ছেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশে নবাব পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারিনি। এমনকি এখন যারা নবাবের রক্তধারা বয়ে আমাদের দেশে রয়েছেন, তাদের জন্যও কিছু করতে পারছি না বা করছি না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই কাজটা করতে আমাদের সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিরাজউদ্দৌলাকে কেবল পাঠ্যবইয়ে আটকে রাখলে চলবে না। তার বংশধরদের জীবিত উত্তরাধিকার ও সংগ্রামকে জানাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। এতে সিরাজকে কেবল পরাজিত নবাব হিসেবে নয়, বরং স্বাধীন বাংলার প্রথম শহিদ ও প্রতিরোধযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করাতে হবে।’

অন্যদিকে গবেষক ও ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ নুরুল হুদা ডিউক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদি সিরাজের নবম প্রজন্ম নবাবজাদা আব্বাসউদ্দৌলাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তিনি সিরাজের অপূর্ণ স্বপ্নকে পূরণ করতে পারবেন বলে আমার ধারণা। কারণ, তার মধ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলার মতই দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। এবং তিনি তা উত্তরাধিকার সূত্রে ধারণ করছেন।’

তিনি আরও বলে, ‘সিরাজউদ্দৌলা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বাংলাকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু তার বংশধররা এখনো বাংলার মাটিতে বেঁচে আছেন। নবাবজাদা আব্বাসউদ্দৌলা আরেবের মতো উত্তরাধিকারিদের যদি সমাজসেবা, জনকল্যাণ বা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে সিরাজের সেই অসমাপ্ত স্বপ্নের দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারবে।’

নবাব সিরাজউদ্দৌলা একসময় ষড়যন্ত্রে পরাজিত হলেও তার রক্তধারা পরাজিত হয়নি। ঢাকার বুকে আজো তার নবম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব ওরফে নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলার মতো যোগ্য উত্তরাধিকার জীবন্ত স্মারক হয়ে আছেন। লক্ষ্য এখন একটাই হওয়া উচিত— তাদের কণ্ঠস্বর, উত্তরাধিকার ও সেই ইতিহাসকে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

উড়িষ্যা জন্মদিন নবাব মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার

বিজ্ঞাপন

কুয়াকাটায় আইনজীবীকে কুপিয়ে জখম
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর